ভূমিকা
{১৯৮৭ সাল, ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র আমি তখন, ইংরেজিতে খুব দুর্বল ছিলাম (এখনও আছি); স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক প্রতি ক্লাসেই আমাকে কান-ধরে দাড় করিয়ে রাখতেন; সাথে বেতের ছড়ির আদর ফ্রি। একদিন স্কুলে গিয়ে শুনলাম, ইংরেজি ক্লাসের সময়ে হলরুমে রচনা লেখা প্রতিযোগিতা হবে; যারা অংশ নেবে, তাদের ক্লাসে না থাকলেও চলবে! আমাকে আর পায় কে; আজ বেতের আদর থেকে বেঁচে আসি!
তারপরেরটুকু ইতিহাস। কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই পুরো স্কুলের মধ্যে প্রথম হয়েছিলাম আমি সে প্রতিযোগিতায়! বিষয় ছিলো, আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)। আয়োজন করেছিলো, ইসলামী ছাত্রশিবির!
তখন থেকে কেন জানি না, এই মানুষটিকে নিয়ে জানার আগ্রহ বেড়ে গেলো; সেই ১৯৮৭ থেকে এই ২০১৬ পর্যন্ত, আমি দিনের ৮ ঘন্টা সময় ব্যয় করি, কেবল একটা বিষয় নিয়ে; তা হচ্ছে নবী মুহাম্মদ। আমার চিন্তা এতটাই একমুখী হয়ে গেল যে, নিয়মিতভাবে মানুষটাকে আমি স্বপ্নে পর্যন্ত দেখতে লাগলাম, এমনও দেখতে শুরু করলাম, নবী মুহাম্মদ আমাকে নিজেই হাত ধরে মক্কা-মদিনার অলিগলি আর সমাজব্যবস্থা বোঝাচ্ছেন! আমার পাগলামী চুড়ান্ত পর্যায় পৌঁছায় তখন, যখন আমার নিজের মনে হতে থাকে, নিশ্চয়ই আমি নিজেই পূর্বজন্মে নবী মুহাম্মদ ছিলাম!
অষ্টম শ্রেনীতে পড়ার সময় থেকে আমার মুক্তচিন্তার বোধ জাগ্রত হতে থাকে; তারপর থেকে আমি ধর্মে বিশ্বাস হারাতে শুরু করি। আর এটাও আমার জন্য সহজ হয়ে যায়, কারণ আমি নবী মুহাম্মদকে নিজের চাইতেও ভালভাবে বুঝতে পারতাম; যখন আমি ১৯৯৩ সালে কলেজে ১ম বর্ষের ছাত্র, আমাকে তখন জাকির নায়েকের কপি বলা যেতে পারতো। না দেখে কোরআন-হাদিস কোট করতে পারতাম আমি; ১৯৯৪ সালে আমি পুরোদস্তুর নাস্তিকে রূপান্তরিত হই, তারপর থেকে চলছে। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত প্রবীর ঘোষের সাথে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছি; পরিবারের উৎসাহে তাবলীগ করেছি, হজ্জ করেছি; পেশাজনিত কারণে লুকিয়ে চর্চা করেছি মুক্তচিন্তার। ইচ্ছে ছিলো, নবী মুহাম্মদের মত বয়স চল্লিশ না হলে কিছুই লিখবো না, আগে রসদ জমাই! চল্লিশে পা দিয়েই করি Ôনরসুন্দর মানুষ’ নামে আত্মপ্রকাশ!
এই সিরিজটি গত ২৫ বছর ধরে জমানো রসদের কিছু অংশ প্রকাশ করবে মাত্র। আমার একটি নোটবুক আছে, তাতে ধর্মের যে সকল বিষয় নিয়ে দ্বিধায় পড়তাম, তার ফুটনোট লিখে রাখতামআমি। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, তারও সিরিয়াল সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে; তার থেকে বেছে বেছে কিছু তুলে আনবো এই সিরিজটিতে।
লেখার ধরনটা থাকবে Ôআরজ আলী মাতুব্বর’ ঘরানার! দ্বিধার বিষয়টি কেবল তুলে ধরবো আমি, সিদ্ধান্ত নেবার পথ পুরোটাই খোলা থাকবে পাঠকের জন্য!
পরিশেষে,
এখনই এই সিরিজটি শুরু করার ইচ্ছা ছিলো না, কারণ ‘৪১ হাজার হাদিসের ধারাবাহিক সংক্ষিপ্ত সংকলন’-এর কাজ করছি, ‘কোরআন যেভাবে অবতীর্ণ’ সিরিজটি ধর্মকারীতে চলছে; কোরআনের একটি Ôমুক্তচিন্তার তাফসীর’ লেখার চেষ্টা করছি; আর রসদ যোগাচ্ছি ‘মানুষ মুহাম্মদ’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ নবী মুহাম্মদের জীবনী লেখার! কিন্তু, ধর্মপচারক ভাইয়ের কাছে একবার মুখ ফসকে এই সিরিজটির কথা বলেই ধরা পড়ে গেছি আমি; তার চোখে আমি Ôনরসুন্দর অমানুষ’! তাই অমানুষের পরিচয় দিতেই হবে আমাকে!
এই সিরিজটি তাই ধর্মপচারকভাইকেই উৎসর্গ করলাম!}
তো, শুরু করা যাক!
সত্যবাদী কে?
বলা হয়, নবী মুহাম্মদ অনুসারী প্রায় সকল Ôসাহাবী’ ছিলেন চূড়ান্তভাবে সত্যবাদী; এর মধ্যে অনেক সাহাবীকেই নবী মুহাম্মদ বেহেস্তী হবার সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন। সাধারণ মুসলিমগণও একথা প্রশ্নাতীত ভাবে বিশ্বাস করে, কিন্তু হাদীস এবং নবী ও সাহাবীদের জীবনী আমাদের মাঝে মধ্যেই ভিন্ন কথা শোনায়!
এ কথা সত্য, নবী মুহাম্মদের সবচেয়ে ছোট এবং প্রিয় স্ত্রী আয়েশার সাথে নবী মুহাম্মদের চাচাতো ভাই এবং মেয়ে জামাই আলী’র মনোগত বিরোধ ছিলো (অন্য কোনো পর্বে বিস্তারিত); তাই বলে দু'জন যখন একই বিষয়ে বিপরীত বক্তব্য দেন, তখন ধাঁধায় পড়তে হয়, কে সত্য বলছেন; আর কে মিথ্যা!
যখন আয়েশা বলেন,
Ôআমার গন্ড আর সীনার মধ্যে থাকা অবস্থায় নবী মুহাম্মদ ইন্তিকাল করেন!’
আবার যখন আলী বলেন,
Ôআমার গ্রীবা ও বুকের মাঝখানে আপনার পবিত্র মস্তক থাকা অবস্থায় আপনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন!’
তখন চিন্তায় পড়তে হয় আমাদের!
আয়েশার বর্ণনা যেমন সহীহ বুখারীর অংশ, তেমনিআলীর বর্ণনা নাহজ আল-বালাঘা’র অংশ। বলে রাখাদরকার, Ôশিয়া’ সংকলন Ôসুন্নী’ সংকলনেরচাইতে বেশি ধারাবাহিক রাবীদ্বারা সংকলিত; কারণ শিয়াসম্প্রদায়ের জন্ম হয়েছিলো নবী মুহাম্মদ জীবিত থাকা অবস্থাতেই। আরসুন্নী হাদিস সংকলন হয়েছেমুহাম্মদের মৃত্যুর দুইশত বছর পর থেকে। আর নবী মুহাম্মদ যে ১০ জনকেবেহেস্তে যাবার সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন, আলী তার মধ্যেএকজন। আয়েশার হিসাব আসে ২০ এর আরও পরে!
আমরা যদি কোনো পক্ষনা নিয়ে চিন্তা করি, তবে সত্যিই মাথা ঘুরতেবাধ্য, কার বুকে মাথা রেখে নবী মুহাম্মদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন: আয়েশার না আলীর..?
আলী সত্যবাদী হলে, আয়েশামিথ্যাবাদী হন; আর আয়েশাসত্যবাদী হলে, আলী হন মিথ্যাবাদী! কাউকে মিথ্যাবাদীর তকমা না দিলেও, এ প্রশ্ন করা যেতেই পারে:
সত্যবাদী কে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন