লিখেছেন শেখ মিলন
পড়ন্ত বিকেল। শরতের বিকেল। বিকেলের ম্লান রোদ আলতো করে গায়ে মেখে আমি কালো পিচ রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছি। গন্তব্য বোস বাড়ির পুজোমণ্ডপ। আজ অষ্টমী। অথচ আমার এখনো প্রতিমাদর্শন হয়নি। সময়ে কুলিয়ে উঠতে পারি না, ক্লাস আর টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত জীবন। আমার বন্ধু সুশীল বোস বলেছে আজ বিকেলে তাদের বাড়ি যেতে। ধীর গতিতে আপন মনে হেঁটে চলেছি। চৌরাস্তা পেরিয়ে পুকুরঘাট ছাড়িয়ে বামদিকে মোড় নিয়ে যেই না দশ-বারো পা এগিয়েছি, হঠাৎ শুনি পেছন থেকে:
- আস্ সালামু ওয়ালাইকুম।
চামড়ার মুখ, পা ফসকে মনের অজান্তেই বলে উঠি:
- অলাইকুম আচ্ছালাম।
পেছন ফিরে দেখি একজন জোব্বা-পাগড়ি পরা, তার সাথে কয়েকজন পাঞ্জাবি পরা দাড়ি-টুপিওয়ালা মানুষ। তারা এগিয়ে আসতে থাকে আমার দিকে, সামনে দাঁড়িয়ে মুসহাফার(হ্যান্ডশেক) জন্য হাত বাড়িয়ে প্রশ্ন করে জোব্বাপরা লোকটি:
- কেমন আছেন?
- ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?
- আলহামদুলিল্লাহ। কেউ কেমন আছেন জানতে চাইলে আল্লাহর শোকর গোজার করে বলতে হয় আলহামদুলিল্লাহ। কারণ মহান আল্লাহ তা'লা আমাদের ভাল রেখেছেন।
আমার মনে প্রশ্ন জাগে 'আল্লাহ আমাকে ভাল রেখেছেন বলে তার শোকর গোজার করবো, কিন্তু যাকে খারাপ রেখেছে সে আল্লাহর কী করবে? আরও প্রশ্ন জাগে 'আলহামদুলিল্লাহ অর্থ 'সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য' এটা কীভাবে 'কেমন আছেন?' প্রশ্নের জবাব হয়? যদি প্রশ্নটি হতো 'সকল প্রশংসা কার জন্য?' বা 'আল্লাহর জন্য কি?' তখন হয়তো উত্তর হতো আলহামদুলিল্লাহ।
আমার মনে এতো প্রশ্ন জাগার সময় দেওয়ার সময় তাদের নেই, তাই আমার ভাবনার মাঝে ছেদ ফেলে তিনি বললেন:
- আমরা বহুদূর থেকে এই মসজিদে তাবলিগে এসেছি, এখানকার মানুষদের দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য। আপনি তো এখানের মানুষ?
- জ্বী।
- তাহলে আসুন আমাদের সাথে। মসজিদে দ্বীনের কথা হচ্ছে। একটু বসে যান। আল্লাহর ঘরে বসলে, দ্বীনের কথা শুনলে অনেক সোওয়াব হবে।
আমি ভাবছি আল্লাহর ঘর? আল্লাহর আবার ঘরের কী প্রয়োজন? নিরাকার আল্লাহ কি ঘরে বাস করে? আমি কিছু বলার বা বুঝে ওঠার আগেই তিনি তাঁদের একজনকে নির্দেশ দেন আমাকে মসজিদে নিয়ে যেতে এবং তাঁরা হাঁটতে থাকেন নতুন কোনো মুসাফিরের উদ্দেশে। লোকটি এগিয়ে এসে আমাকে বললেন:
- আসুন ভাই, মসজিদে যাই।
অগত্যা হতভম্ব আমি তাকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলছি মসজিদের দিকে। তিনি প্রশ্ন করলেন:
- আপনি কী করেন?
- আমি ছাত্র। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ি ।
- মাশআল্লাহ। কোন সাবজেক্টে পড়েন ভাই?
- অ্যাকাউন্টিং।
- আছরের নামায আদায় করেছেন?
- জ্বী না।
- তাহলে মসজিদে গিয়ে আগে নামায আদায় করে নেবেন। এক ওয়াক্ত নামায ক্বাযা করলে ১ লক্ষ ৮৮ হাজার বছর জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হয়। তাছাড়া আল্লাহর এবাদাত করলে আল্লাহ লেখাপড়ায় বরকত দেন, মেধা বাড়িয়ে দেন।
আমি ভাবছি নামায পড়লেই যদি লেখাপড়ায় বরকত পাওয়া যায়, তাহলে অমুসলিমদের পড়ালেখা হয় কীভাবে? আবার সরস্বতীর যারা পুজা করে না, সেইসব অহিন্দুদের লেখাপড়া হয় কীভাবে? আমার ভাবনার মাঝে তিনি আবারও প্রশ্ন করলেন:
- সকল মুসলিম ভাই ভাই। তাই আপনাকেও ভাই বলে ডাকছি। আপনার নামটা যেন কী ভাই?
আমি ভাবছি, সকল মুসলিম যদি ভাই ভাই হয়, তাহলে কি পিতা-পুত্রও ভাই ভাই? আর সকল মুসলিম নারীরা কী? তারা কি বোন বোন? তিনি আবারও প্রশ্নটা করলেন:
- আপনার নামটা যেন কী?
- শুভ ডি কোস্টা।
তিনি ভূত দেখার মতো চমকে উঠে কতক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎই কী যেন বিড়বিড় করতে করতে আমায় ফেলে হনহনিয়ে এগিয়ে চললেন। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। তার উচ্চারিত শব্দগুচ্ছের শেষের অংশটুকু শোনা গেল, যা অনেকটা এরকম: "... মিন জালেক।"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন