লিখেছেন উজান কৌরাগ
আজ আবার এক কাণ্ড ঘটে গেল বাসায়। না, আমাকে নিয়ে নয়। পাঁচতলার একটা বাসা খালি হবে আগামী মাস থেকে, টু-লেট টাঙানো হয়েছে। টু-লেট দেখে সকালের দিকে বছর চল্লিশের এক ভদ্রলোক এসেছিলেন বাসা দেখতে। বাবা তাকে পাঁচতলায় নিয়ে গিয়ে বাসা দেখালেন। বাসা দেখে পছন্দ হওয়ায় ভাড়া নিয়ে কথা বলার জন্য বাবা ভদ্রলোককে আমাদের ড্রয়িংরুমে এনে বসালেন আলাপ করার জন্য। ভদ্রলোকের নাম ইমন, একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন। ভাড়াটিয়া হিসেবে বাবা ইমনকে পছন্দ করেছেন। পরিবারও ছোট; স্বামী-স্ত্রী আর তাদের এক পুত্রসন্তান। তাঁর অফিস এবং অন্যান্য বিষয়ে কিছুক্ষণ জমানো আলাপও করেছেন দু’জন। চায়ের অফার করলেও ইমন বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছেন যে, তাঁর একটু তাড়া আছে, তবে বাসায় যখন উঠছেন, তখন অন্য সময় নিশ্চয় চা খাবেন। প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন যে, বিকেলেই তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন বাসাটা দেখানোর জন্য আর তখনই অ্যাডভান্স ক’রে যাবেন। ইমন চ’লে গেলে বাবা তাঁর প্রশংসা করলেন এই ব’লে যে, ছেলেটা খুবই ভদ্র, বিনয়ী, সজ্জন; ভাল পরিবারের সন্তান, বাবা হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন ইত্যাদি।
বিকেলে আমি ড্রয়িংরুমে বসে ডিসকাভারি দেখছি। কলিংবেল বাজতেই আমি উঠে পা বাড়ালাম, কিন্তু আমার আগেই দরজার কাছে পৌঁছে গেলেন মা। বোধহয়, তিনি নিজের ঘর থেকে ড্রয়িং কিংবা ডাইনিংয়ের দিকে আসছিলেন। দরজা খুলেই থমকে দাঁড়ালেন মা, মায়ের সামনে দাঁড়ানো ইমন আর পিছনে তার স্ত্রী। ইমন বললেন, ‘সকালে বাসা দেখে গেছি, অ্যাডভান্স করতে এসেছি।’
সম্ভবত, মা কিছুটা ইতস্তত, তাই বেশ কয়েক মুহূর্ত পর বললেন, ‘আসেন।’
মা ঘুরে দাঁড়াতেই তার মুখাবয়বের অসন্তুষ্টির ভাষা পড়তে আমার একটুও দেরি হলো না। আমি টেলিভিশন বন্ধ ক’রে নিজের ঘরে প্রবেশ করলাম। ইমন এবং তার স্ত্রীকে ড্রয়িংরুমে বসতে দিয়ে মা গেলেন নিজের ঘরে, সেখানে বাবা আছেন। স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি সময় পর বাবা এলেন ড্রয়িংরুমে, কেন তার এই সময়ক্ষেপণ, তা আমার কাছে পরিষ্কার। বাবা কিছুটা বিব্রত, বাবার এই বিব্রত ভাবের কারণ আগেই আঁচ করতে পেরে আমি আমার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কান সজাগ রাখলাম।
বাবা বললেন, ‘ব্যাপারটা কীভাবে আপনাদেরকে বলি, বলতে সংকোচও হচ্ছে। আসলে আপনাকে যে-ফ্ল্যাটটা দেখিয়েছি, সেটায় আমার বড়বোন উঠবে। আমার বড়বোন নাকি মাকে আগেই বলেছে, কিন্তু মা আমাকে জানাতে ভুলে যাওয়ায় আমি আপনাকে বাসা দেখিয়েছি। আপনারা শুধু শুধু কষ্ট ক’রে এলেন, কিছু মনে করবেন না।’
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা, তারপর ইমন বললেন, ‘ঠিক আছে...’
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে ইমনের স্ত্রী বললেন, ‘আপনার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। হয়তো কোনো কারণে আপনি আমাদেরকে বাসা ভাড়া দিতে চাচ্ছেন না। সেটা আপনি না দিতেই পারেন, কিন্তু সেটা শুরুতে বলাই ভদ্রতা। কেননা, আমাদের সময়ের মূল্য আছে। চলো...।’
দারুণ স্মার্টলি কথাগুলো বললেন ইমনের স্ত্রী। বাবার মিথ্যা বলার ধরনটা বেশ অপটু, ফলে ইমনের স্ত্রীর মনে কোনো সন্দেহ দানা বাঁধা অস্বাভাবিক নয়। আবার এমনও হতে পারে যে এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাঁরা আগেও পড়েছেন, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই কিছু আঁচ করতে পেরেছেন। উঠে পড়লেন দু'জনই। বাবা বললেন, ‘না, না, আপনাদের বাসা ভাড়া দেব না কেন! আসলে আমার মায়ের ভুলেই...।’
‘রোজার দিনে মিথ্যা বলতে হয় না, আংকেল।’ ইমনের স্ত্রীর ইয়র্কারে বাবা এবার ক্লিন বোল্ড!
ইমন বললেন, ‘বাদ দাও, চলো। ঠিক আছে, আংকেল। আসি।’
বাসা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন দু’জনই। আমি আমার ঘর থেকে বের হলাম, টেবিলে রাখা জগ থেকে একগ্লাস জল খেয়ে দরজা বন্ধ করলাম। এরই মধ্যে আড়চোখে তাকিয়ে পড়লাম বাবার মুখের ভাষা। অপরাধীর মতো বসে আছেন সোফায়। আমি বললাম, ‘কিছু মনে ক’রো না বাবা, এর পর থেকে কেউ বাসা ভাড়া নিতে এলে হয় তাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা ক’রো: সে সুন্নি মুসলমান নাকি অন্য কোনো সম্প্রদায়ের, অথবা তোমাদের এই ক্ষুদ্রতা ত্যাগ ক’রো। তাহলে মানুষকে হয়রানি করা হবে না আর তোমাকেও অপমানিত হতে হবে না। নিজে না পারো, এরশাদুলকে ব’লে রেখ, যাতে টু-লেট দেখে কেউ এলে ও প্রথমেই জেনে নিতে পারে।’ এরশাদুল আমাদের বাড়ির দারোয়ান।
আসলে যতো গোল লেগেছে ভদ্রলোকের ইমন নামটা নিয়ে। ইমন নাম শুনে বাবা মনে করেছিলেন ভদ্রলোক মুসলমান, ইমন নাম যে হিন্দুদেরও হতে পারে, এটা বাবা ভাবেননি। আর ইমনকে দেখে এবং তার কথা শুনে বাবা অপছন্দনীয় কিছু পাননি, ফলে তিনি তাকে বাড়িভাড়া দিতে চেয়েছেন এবং তার প্রশংসাও করেছেন মা এবং দাদীর কাছে। কিন্তু ইমনের স্ত্রীর সিঁথির এক চিলতে সিঁদূর এবং দুই হাতের শাঁখা পাল্টে দিয়েছে সবকিছু। মা দরজায় থমকে দাঁড়িয়েছিলেন নিশ্চয় ইমনের স্ত্রীর সিঁথির সিঁদুর দেখে! তারপর বাবাকে গিয়ে বলার পর বাবা ইমনকে বাড়িভাড়া দেবার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছেন।
আমি অবশ্য কী হতে চলেছে, সেটা আগেই বুঝে ফেলেছিলাম ভদ্রমহিলার সিঁথির সিঁদুর দেখে, যদিও এ বিষয়ে আমার কিছু করার ক্ষমতা নেই; তাই আমি এখানে নীরব দর্শকমাত্র। আসলে আমাদের বাড়িতে সুন্নি মুসলমান ব্যতীত অন্য কোনো সম্প্রদায়ের মানুষকে ভাড়া দেওয়া হয় না। এমনকি আহমদিয়া মুসলমানদেরকেও না। একবার এক আহমদিয়া পরিবার উঠেছিল, কিন্তু কিছুদিন পর যখন জানা গেল যে, তারা আহমদিয়া, তখন অন্য কারণ দেখিয়ে তাদেরকে বাড়িছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হলো এবং তারা বাড়ি ছেড়েও গেল। আহমদিয়া পরিবারটি বাড়ি ছাড়ার পর দাদী ওই ফ্ল্যাটে গোলাপজল ছিটিয়েছিলেন আর বাবাকে বলেছিলেন, ‘আধা-হিন্দুগুলা আমার বাড়িডা নাপাক কইরা দিয়া গেল, হিন্দুগো মতো চাল-চলন!’
আর হিন্দুরা তো আমাদের পরিবারের শত্রু! হিন্দুদের জন্যই তো মুসলমানের কলিজাসম পাকিস্তান ভাগ হলো, দাদীর ভাই করাচী গেলেন আর ফিরে এলেন না! হিন্দুরা ঘরে দেবদেবীর ছবি-মূর্তি রাখে, পূজা দেয়, শঙ্খ বাজায়, উলু দেয়; বাড়ি নাকি উপাসনালয় বানিয়ে ছাড়ে। বাড়িতে কোরান শরীফ-হাদিস শরীফ আছে, তা যদি নাপাক হয়ে যায়! তাছাড়া বাড়িতে দেবদেবীর ছবি-মূর্তি থাকলে নাকি ফেরেশতা আসে না! আমি একবার প্রতিবাদ করেছিলাম, কিন্তু আমার প্রতিবাদ ধোপে টেকেনি; এ বাড়িতে আমি নিজেই সংখ্যালঘু! আব্বা আর দাদী তখন আমাকে হাদিস শুনিয়েছিলেন। মুহাম্মদের স্ত্রী আয়েশা বাজার থেকে একটি বালিশ বা গদি কিনে এনেছিলেন, যার মধ্যে ছবি ছিল। মুহাম্মদ ঘরে প্রবেশের সময় যখন সেই ছবি দেখলেন, তখন তিনি ঘরে প্রবেশ না ক’রে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে গেলেন। আয়েশা কারণ জিজ্ঞাসা করলে মুহাম্মদ বললেন, ‘এই বালিশ কীসের জন্য?’
আয়েশা বললেন, ‘এটা আপনার জন্য খরিদ ক’রে এনেছি, যাতে আপনি বসতে পারেন বা হেলান দিতে পারেন।’
মুহাম্মদ তখন বললেন, ‘এই ছবি নির্মাতাকে কিয়ামতের দিন শাস্তি প্রদান করা হবে এবং বলা হবে, যা তুমি সৃষ্টি করেছ তার প্রাণ দাও।’ মুহাম্মদ আরও বললেন, ‘যে ঘরে প্রাণীর ছবি থাকে, সে ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।’
অন্য আরেকদিন মুহাম্মদের কাছে জিবরাঈলের আসার কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও যখন জিবরাঈল এলো না, তখন মুহাম্মদ তার হাতে থাকা লাঠিটা ফেলে দিলেন, তবু জিবরাঈল এলো না। এরপর তিনি এদিক-সেদিক তাকিয়ে চৌকির নিচে একটি কুকুরের বাচ্চা দেখতে পেলেন। কুকুরের বাচ্চাটি কখন ঢুকেছে জানতে চাইলে আয়েশা জানালেন যে, তিনি জানেন না। এরপর মুহাম্মদের নির্দেশ কুকুরটিকে বের ক’রে দেওয়া হলো, আর একটু পরই জিবরাঈল এলো। ওয়াদা দিয়েও সময়মতো আসতে না পারার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জিবরাঈল মুহাম্মদকে জানালো, এতোক্ষণ ঘরে যে কুকুরটা ছিল, সেটাই তাকে আসতে বাধা দিয়েছিল, কেননা কোনো ঘরে কুকুর বা প্রাণীর ছবি থাকলে সেই ঘরে সে প্রবেশ করে না।
সঙ্গত কারণেই আমাদের বাড়িতে হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান ভাড়াটিয়া তোলা হয় না। আমার ঘরে অবশ্য পেইন্টিং, ভাস্কর্য এবং মুখোশ আছে। তবে এর জন্য আমাকে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে হয়েছে। প্রথম যেদিন আমি আমার ঘরের দেয়ালে একটি মুখোশ লাগাই, সেদিনই মুখোশটি ফেলে দেবার নির্দেশ জারি করে বাবা এবং দাদী।
আমি বলেছিলাম, ‘তোমরা যদি কোরান-হাদিস অনুযায়ী সহি ইসলামী জীবন-যাপন করো, তাহলে আমি অবশ্যই মুখোশটি ফেলে দেব।’
বাবা-মায়ের সামনে খেঁকিয়ে উঠেছিলেন দাদী, ‘আমরা সহি ইসলামী জীবন-যাপন করি না তো কি মালাউন গো মতো জীবন-যাপন করি?’
বলেছিলাম, ‘অবশ্যই তোমরা সহি ইসলামী জীবন-যাপন করো না। বাড়ি থেকে আগে টেলিভিশনটা বের ক’রে নাটক-সিনেমা দেখা বন্ধ করো; সাবান-শ্যাম্পু-হারপিক থেকে শুরু ক’রে নানা ধরনের যেসব পণ্যের মোড়ক বা লেবেলে মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর ছবি থাকে, সেসব পণ্য বর্জন করো; যেসব টাকার ওপর বঙ্গবন্ধুর ছবি, পাখির ছবি, বাঘের জলছাপ আছে সেগুলোর ব্যবহার বন্ধ করো; যদি করতে পারো, আমি অবশ্যই মুখোশ ফেলে দেব!’
বাবা হাঁ হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। দাদী গজগজ করতে করতে সামনে থেকে সরে পড়েছিলেন। তারপর বাবাকে বলেছিলাম, ‘বাবা, ধর্ম নিয়ে রোজ রোজ তোমাদের সাথে বাকযুদ্ধ করতে আমার ভাল লাগে না। আমার নিজের পছন্দ-রুচি অনুযায়ী আমি থাকতে চাই, এতে যদি তোমাদের অসুবিধা হয় বলো, আমি হলে গিয়ে থাকবো। সাভারের দিকে দুটো টিউশনি করবো, ওতেই আমার চ’লে যাবে। ’
এই শেষ কথাটায় কাজ হয়েছিল, আমাকে আর কেউ ঘাঁটায়নি। আমার ইসলাম-ত্যাগের প্রথম আড়াই বছর আমি মানসিকভাবে ভীষণরকম নির্যাতিত হয়েছি; এরপর থেকে আমি কৌশল পাল্টেছি, আমাকে মানসিকভাবে পীড়ন করতে এলে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে আমিও পাল্টা আক্রমণ করি। এতে ফল হয়েছে, আমার ওপর মানসিক পীড়ন আগের চেয়ে কমেছে। সকলে বুঝেছে যে, আমি হাওয়ায় গা ভাসিয়ে কথা বলি না, ধর্মগ্রন্থগুলো রীতিমতো ঘাঁটাঘাঁটি করেই তর্ক করি। তাছাড়া আমি যে আর সেই গোপাল টাইপের ছেলেটি নেই, এখন খুব জেদি হয়ে উঠেছি, সেটা বাড়ির সকলেই টের পেয়েছে। কিন্তু যতোই নাস্তিক হই, আমি তো তাদের সন্তান, একমাত্র ছেলে বাড়ি-ছাড়া হলে ব্যথাটা যে তাদের বুকেই বাজবে; ফলে তারা আমার স্বাধীনতায় ব্যাঘাত ঘটায়নি। আমি আমার ঘরের দেয়ালে আরও মুখোশ লাগিয়েছি, একটা পেইন্টিং ঝুলিয়েছি, শেল্ফের ওপর দুটো ভাস্কর্য আর বেশ কয়েকটা পুতুল এনে রেখেছি। এর পর থেকেই, সম্ভবত, গুণাহ্ হওয়ার ভয়ে ছোট আপু ব্যতীত আমার ঘরে খুব দরকার ছাড়া কেউ আসে না। আমাদের বাসায় ঠিকা কাজ করে আসমা আপা, সে আমার ঘর ঝাড় দিয়ে মোছে। দাদী তো আমার ঘরের ছায়াই মাড়ায় না। বাবার আসার প্রয়োজন পড়ে না। খুব দরকার পড়লে মা কখনো-সখনো আসে। ছোট আপু আসে, ঘরটা এলোমেলো থাকলে ও মাঝে মাঝে গুছিয়ে দেয়।
বাবা-মা এখনো স্বপ্ন দ্যাখে যে, বয়স বাড়লে হয়তো আমার মাথা থেকে নাস্তিকতার ভূত ছেড়ে যাবে; এই ভেবেই তারা তাদের আল্লাহকে ডাকেন, ইসলামের দিকে আমার মন ফেরানোর জন্য দোয়া-দরুদ পড়েন!
আমার কম্পিউটারের মাউসটা নষ্ট হয়ে গেল হঠাৎ, তাই শেষ বিকেলে বাইরে বেরোলাম মাউস কিনতে। ১০ নম্বর না গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চ’লে গেলাম ১ নম্বরে, উদ্দেশ্য - হেঁটে সন্ধেটা বাইরে কাটিয়ে আসা। ইফতারের কিছুক্ষণ আগে মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের তিনতলার একটা দোকান থেকে মাউস কিনে আবার ফেরার পথ ধরলাম। ২ নম্বর চত্বর, মানে সনি হলের কাছে এসে মনে হলো, এখনই বাসায় ফিরে কী করবো, তার চেয়ে ভিড়হীন ফুটপাতে হাঁটি। সোজা না গিয়ে পা বাড়ালাম চিড়িয়াখানা রোডের দিকে, রাস্তাটা সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে চিড়িয়াখানা আর বোর্টানিক্যাল গার্ডেনের গেটের মুখে। আমি হাঁটছি আর আশপাশের দোকানগুলোর দিকে তাকাচ্ছি। দোকানের লোকজন মাথায় টুপি প’রে ইফতার সামনে নিয়ে ব’সে আছে আযানের অপেক্ষায়, একটু পরই তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চতুর্দিক থেকে একের পর এক হেঁকে উঠলো মসজিদের মাইক।
ফুটপাত ভাঙাচোরা, কোথাও বা তা গাড়ির গ্যারেজগুলোর দখলে, রাস্তারও প্রায় অর্ধেক জুড়ে গাড়ি রাখা। রাস্তা এবং ফুটপাত দখল করেই চিড়িয়াখানা রোডে গাড়ি মেরামত করা হয়। গ্রিলের দোকানগুলো ফুটপাত দখল করেই গ্রিল কাটে, ঝালাই করে, ছিটকে বেরোয় আগুনের ফুলকি; এর ভেতর দিয়েই মানুষকে চলাচল করতে হয়। সারাক্ষণ লোহা-লক্করের শব্দে কানে তালা লেগে যায়। এখন অবশ্য বেশ সুনসান, সবাই ইফতারে ব্যস্ত। এই যে ফুটপাত আর রাস্তার দখল নিয়ে দিনের পর দিন এরা পথচারীদের অসুবিধায় ফেলে নিজেদের কার্য সম্পাদন ক’রে চলেছে, এসব দেখার জন্য এই শহরে কেউ আছে বলেই মনে হয় না। রাইনখোলা বাসস্ট্যান্ডের কাছে এসে বটগাছের নিচের দাঁড়ালাম। যাত্রীর অপেক্ষায় কোনো বাস নেই, যাত্রীও নেই বাসের অপেক্ষায়। অনেকক্ষণ পর পর একটা-দুটো রিক্সা যাচ্ছে-আসছে। রাস্তার ওপাশেই কাঁচা-বাজার, ভিড় নেই ওখানেও। এই ফাঁকা রাস্তা দেখে মনে হলো, ইস্, সবসময় যদি রাস্তা এমন ফাঁকা থাকতো! মিরপুরের ভিড়টা আজকাল দুঃসহ হয়ে উঠেছে। বছর পাঁচ-ছয় আগেও মিরপুরে এতো মানুষের চাপ ছিল না। আর দশ-বারো বছর আগের আমার কৈশোরের কথা মনে পড়লে তো কেবলই দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে বুক থেকে! ১০ নম্বর চত্বর থেকে বাসার দিকে হেঁটে এলে কারো গায়ের সাথে গা লাগতো না, ফুটপাতগুলো এখনকার মতো এতোটা দখল হয়নি। এখন গোলচত্বরে গিয়ে দাঁড়ালে কেবল ব্যস্ত মানুষের চতুর্মুখী স্রোত চোখে পড়ে; এ ওকে অতিক্রম ক’রে, ও তাকে ঠেলে বা ধাক্কা দিয়ে ছুটছে। এতো বাস তবু জায়গা নেই, ঠেলাঠেলি ক’রে একে-অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাসে উঠছে মানুষ। অথচ পাঁচ-ছয় বছর আগেও মিরপুরে এতো বাস ছিল, এখন নতুন নতুন কতো বাস নেমেছে কিন্তু তাতেও কুলোচ্ছে না। চতুর্দিকের রাস্তায় যানজট, বাসগুলোর মধ্যে চলছে আগে যাবার প্রতিযোগিতা, সংঘর্ষও! প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। পৃথিবীর বসবাসের অযোগ্য বড় শহরগুলোর তালিকায় ঢাকা এখন শীর্ষেই থাকে। বাবার মুখে শুনেছি যে, আগে মিরপুরের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, একতলা-দু’তলা বা টিনের ঘর, ঘরের আশপাশে গাছপালা; রাস্তার মোড়ে মোড়ে বটগাছ আর কৃষ্ণচূড়া গাছ, যেখানে বসে মানুষ চা খেতে খেতে আড্ডা দিতো; খোলা জায়গাও ছিল অনেক বাচ্চাদের খেলার জন্য। বাবার কথা কী বলবো, আমরাও তো কতো খেলার জায়গা পেয়েছি। চোখের সামনে সেইসব জায়গা বৃক্ষশূন্য হয়ে গেছে, গড়ে উঠেছে বিল্ডিং।
দেশের বেশিরভাগ মধু রাজধানীতে এনে জমা ক’রে রেখেছে সরকার, মানুষ তো সারাদেশ থেকে পিঁপড়ার মতো ছুটে আসবেই। কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য সুবিধা সারাদেশে ছড়িয়ে দিলে আজ ঢাকা শহরের এই দুরবস্থা হতো না। তার ওপর বছর বছর নদী ভাঙনে বিলুপ্ত হচ্ছে জনপদ; সরকার তাদের পুনর্বাসন এবং কর্মসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না। ফলে জমিজমা-ঘরবাড়ি হারানো নিঃস্ব মানুষ দুটো খেয়ে বাঁচার জন্য ছুটে আসছে রাজধানীর দিকে। কোথাও কাজ না পেলে গুলিস্তান কিংবা বঙ্গবাজার থেকে কাপড়-চোপড় বা অন্য কোনো পণ্য কিনে এনে ফুটপাতে যত্র-তত্র ব’সে যাচ্ছে বিক্রির জন্য। মেইনরোড তো বটেই, ক্রমশ ভেতরের দিকের রাস্তার ফুটপাতও হকারদের দখলে চ’লে যাচ্ছে। তবু তো এরা কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের পথ বেছে নিচ্ছে, কিন্তু ঢাকামুখী এইসব নিঃস্ব মানুষের আরেকটা অংশ জড়িয়ে পড়ছে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে; পুলিশের প্রশ্রয়েই এই অপরাধ তারা করছে, নাকাল হচেছ নগরবাসীর জীবন। এমনিতেই নগরবাসী নাকাল নয়-দশ ঘন্টার কর্মঘন্টা, জ্যামে ঠেলে কর্মস্থলে যাতায়াতে তিনচার-ঘন্টা, বছর বছর ঊর্ধ্বমুখী বাড়িভাড়া, লাগামহীন বাসভাড়া, ছেলে-মেয়েদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ বেতন, হাসপাতাল সেবার অমানবিক মূল্য, ওষুধের উচ্চ মূল্য, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, নিত্যনৈমিত্তিক দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধিতে। তার ওপর চুরি, ছিনতাই বা অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা কারো কারো জীবনে মরার ওপর খরার ঘা হয়ে আসে। পুলিশও কি কম হয়রানি করে! এই যে আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি, এখন যদি পুলিশ আমার পকেটে এক পুরিয়া গাঁজা বা গোটাকতক ইয়াবা গুঁজে দিয়ে আমাকে অপরাধী বানিয়ে মামলা করার ভয় দেখিয়ে আমার পরিবারের কাছ থেকে মোটা টাকা খসিয়ে নেয়, তাহলে কারো কিচ্ছু করার নেই; এমন ঘটনা আজকাল হরহামেশাই ঘটছে! একটা-দুটো ঘটনা হয়তো মিডিয়ায় আসছে, মিডিয়াকে দেখাতে দোষী পুলিশকে প্রত্যাহার করা হচ্ছে, কিন্তু পুলিশের সাজানো বিচিত্র ধরনের আরো হাজারো ঘটনা ঘটছে এবং তা আমাদের অগোচরেই থেকে যাচ্ছে।
পুরোনো দিনের কথা বলতে বলতে আমার দাদা দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন, আবার বাবাও দীর্ঘশ্বাস ফেলেন; বাপ-দাদার সঙ্গে এই ব্যাপারে আমার দারুণ মিল, আমার দেখা শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোর কথা মনে ক’রে আমিও এরই মধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুরু করেছি।
আমি আবার পা চালালাম। রাইনখোলা মোড় থেকে ঢাল বেয়ে সোজা হেঁটে বিসিআইসি স্কুলের সামনের অবিভাবকদের জন্য নির্মিত বেঞ্চে বসলাম। আমি বিসিআইসি স্কুল এবং কলেজে পড়েছি। ঘনীভূূত অন্ধকারে এখানে এসে বসতেই হাজারো স্মৃতি বুদবুদের মতো ঠেলে উঠলো মনের ভেতর; কতো দুষ্টুমি, মারামারি আর আড্ডায় কেটেছে সময়। কতো বন্ধু-বান্ধব ছিল, এখন মাত্র কয়েকজনের সঙ্গেই যোগাযোগ আছে। বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা জায়গায়, কেউবা চ’লে গেছে দেশের বাইরে।
হাঁটতে হাঁটতে চ’লে এসেছি বাসার কাছে। আজ চতুর্থ রোজা শেষ হলো, এখনও কেনাকাটার ধুম লাগেনি ব’লে ইফতারের পরও রাস্তা বেশ ফাঁকা। সদরগেটের লক খুলে গ্যারেজে প্রবেশ করতেই শোরগোল শুনতে পেলাম। চাচা, চাচী, বড় ফুফু-মেজো ফুফুর গলা শুনতে পাচ্ছি, মনে হচ্ছে দোতলায় কিছু হয়েছে। আমাদের দারোয়ান এরশাদুল নিচতলার সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে কান খাড়া ক’রে ওপর দিকে তাকিয়ে আছে। এরশাদুল আমার সমসময়ী অথবা এক-আধ বছর এদিক-ওদিক হবে, একটা জাত হারামি! মেজো ফুফুর শ্বশুরবাড়ির গ্রামে ওর বাড়ি। মেজো ফুফু-ই ওকে এনেছে, সেই সূত্রে ও মেজোফুফুর চ্যালা। ভুরি ভুরি মানুষের খবর মেজোফুফুর সংগ্রহে থাকে। আশপাশের কার বাড়িতে কী হয়, কার ছেলে কী করেছে, কার মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছে, কোন বাসার ভাড়াটিয়া কেমন, কোন কোন বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার সঙ্গে ঝগড়া করে, চাচীর দূর সম্পর্কের কোন বোনের ডিভোর্স হয়েছে কিংবা চাচার কোন কলিগের মেয়ের বিয়েতে একশো ভরি গহনা দিয়েছে, মেজো ফুফার খালাতো ভাই ঘুষ খেয়ে হঠাৎ ধনী হয়ে উঠেছে, আমাদের ছয়তলার ভাড়াটিয়া মানে আমার চাচীর বান্ধবী তার খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে পরকীয়া করছে, মালিহার কোন বান্ধবীর বাবা-মায়ের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হতে চলেছে, কার কার সংসারে শান্তি নেই; এইসব খবরে আমার মেজোফুফুর মাথা ঠাসা থাকে। তাই মেজো ফুফুকে আমি বলি সিএনএন, আর মেজো ফুফু সিএনএন হলে এরশাদুল দুঁদে রিপোর্টার। আশপাশের তাবৎ বাড়ির দারোয়ান আর কাজের বুয়াদের সঙ্গে ওর যতো সখ্যতা, সেই সূত্রে ও সংবাদ সংগ্রহ ক’রে এনে সিএনএন-এ লোড করে! একটা সহজ বিষয়েও ইনিয়ে-বিনিয়ে প্যাঁচ লাগায়, এর কথা ওর কানে লাগায়। ভাড়াটিয়াদের খুঁত খুঁজে বের ক’রে মেজোফুফু তো বটেই বাবা-মা, চাচা-চাচী এবং দাদীর কান ভাঙায়। ওর কথায় বাবা বেশ কয়েকটা পরিবারকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে।
আমাকে দেখে ও সিঁড়ির কাছ থেকে স’রে এলো। আমি মুখে কিছু বললাম না, শুধু চোখে চোখ রেখে আঙুল দিয়ে ওর ঘরের দিকে নির্দেশ করলাম, ও সুর সুর নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। আমিও সিঁড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুনতে পেলাম চাচার কন্ঠস্বর, ‘বাড়ি করার টাকা তো চোদায়ে আনছিলাম!’
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন