বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৬

ইসলামী পাটিগণিত - ১

লিখেছেন আবুল কাশেম

সূচনা

ইসলামী পণ্ডিতেরা এবং ইসলামী ঐতিহাসিকেরা সর্বদাই প্রচার করে চলেছেন যে, বিশ্বকে অঙ্কশাস্ত্র বিশেষত বীজগণিত উপহার দিয়েছে ইসলাম। ভাব-সাব এমন, যেন ইসলামের পূর্বে বিশ্বে অঙ্কশাস্ত্রের প্রচলন ছিল না। কিন্তু সত্য হল, সংখ্যাতত্ত্ব বিশেষত আধুনিক দশমিক সংখ্যা তথ্যের উদ্ভব করেছে হিন্দুরা — ভারতবর্ষেই। পরে আরবেরা এই সংখ্যা-তত্ত্ব অবলম্বন করে এবং ধীরে ধীরে তা বিশ্বের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

এই রচনায় আমরা দেখব, ইসলামের উৎস, তথা কোরান এবং হাদিসগুলোতে কীভাবে পাটিগণিতের ব্যবহার করা হয়েছে।

আল্লাহ্‌র পরিসংখ্যান তথ্য

আমরা প্রথমেই দেখি কোরানে আল্লাহ্‌ তা’আলা লিখেছেন যে, তিনি পাটিগণিত জানেন। সূরা মারইয়ামে আল্লাহ্‌ লিখেছেন:
১৯:৯৪ তাঁর কাছে তাদের পরিসংখ্যান রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে গণনা করে রেখেছেন। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ্‌ তা’লার কাছে বিশ্বের সবকিছুর হিসাব রয়েছে। আমরা ধরে নিতে পারি, এই হিসাবের জন্য পাটিগণিতের মৌলিক বিধান—যথা যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ ইত্যাদি আল্লাহ্‌ তা’আলা খুব ভালোভাবেই জানেন। আরও ধরে নিতে পারি যে, আল্লাহ্‌র কাছে যে-পরিসংখ্যান আছে, তা নির্ভুল এবং সাম্প্রতিক। অর্থাৎ আল্লাহ্‌ পাক অনুমানের ওপর হিসাব রাখেন না।

আয়াত ১৯.৯৪-এর প্রসঙ্গ হচ্ছে: আল্লাহ্‌ জানলেন যে, খ্রিষ্টানেরা নাকি বলেছে যে, আল্লাহ্‌র এক সন্তান আছে। এই ব্যাপার জেনে আল্লাহ্‌ অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে পড়লেন, এবং দাবি করলেন যে, তিনি সবকিছুই গণনা করে সব কিছুর তথ্য ও হিসাব জানেন। এই প্রসঙ্গে ইব্‌নে কাসীর লিখেছেন:
সবারই গণনা তাঁর কাছে রয়েছে। তাঁর জ্ঞান সবকে পরিবেষ্টন করে আছে। সবাই তাঁর ক্ষমতা আওতার মধ্যে রয়েছে। সমস্ত পুরুষ, নারী, ছোট ও বড় এবং ভাল ও মন্দের খবর তিনি রাখেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত কিছুর জ্ঞান তাঁর আছে। (তাফসীর ইব্‌নে কাসীর, চতুর্দশ খণ্ড, পৃঃ ২০৩)।
সূরা আস-সাফ্‌ফাতে হযরত ইউনুস প্রসঙ্গে আল্লাহ্‌ পাক লিখেছেন:
৩৭:১৪৭ এবং তাঁকে, লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করলাম।
৩৭:১৪৮ তারা বিশ্বাস স্থাপন করল অতঃপর আমি তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবনোপভোগ করতে দিলাম। [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ্‌ তা’লা তাঁর পরিসংখ্যান সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান রাখেন না। আল্লাহ্‌ হযরত ইউনুসকে মাছের পেটের থেকে মুক্তি দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন মসুলের কাছে নিনেভার জনতার মাঝে। কিন্তু তখন নিনেভার জনসংখ্যা কত ছিল, আল্লাহ্‌ সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য রাখেননি। এই সমস্যা এড়াবার জন্য কোরানের ব্যাখ্যাকারীরা নানা আবোল তাবোল লিখেছেন; যেমন ইব্‌নে কাসীর লিখেছেন:
তাদের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ ত্রিশ হাজার বা এর চেয়েও কিছু বেশী বা সত্তর হাজারের বেশী অথবা এক লক্ষ দশ হাজার। একটি মারফূ’ হাদিসের বর্ণনা হিসেবে তাদের সংখ্যা ছিল এক লক্ষ বিশ হাজার। (তাফসীর ইব্‌নে কাসীর, ষষ্টদশ খণ্ড, পৃঃ ২৩০)।
এদিকে পরিসংখ্যানে আল্লাহ্‌র জ্ঞানের স্বল্পতা ঢাকতে মাওলানা মৌদুদি লিখেছেন:
এক লাখ বা এর বেশী ”বলার মানে এ নয় যে, এর সঠিক সংখ্যার ব্যাপারে আল্লাহ্‌র সন্দেহ ছিল বরং এর অর্থ হচ্ছে, যদি কেউ তাদের জনবসতি দেখতো তাহলে সে এ ধারণাই করতো যে এ শহরের জনসংখ্যা এক লাখের বেশীই হবে, কম হবে না। (তাফহীমুল কুর আন, সূরা আস্‌ সা-ফ্‌ ফা-ত, পৃঃ ৭৫)।
এই প্রসঙ্গে একটি হাদিসও উল্লেখ করা যেতে পারে:
আলী ইব্‌ন হুজর (র)...উবাই ইব্‌ন কা’ব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: তাকে (ইউনুস আ) আমি লক্ষ বা ততোধিক লোকের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম (সাফ্‌ফাত ৩৭:১৪৭) আয়াতটি সম্পর্কে আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বলেছেনঃ এরা ছিল (এক লক্ষ) বিশ হাজার।
হাদীছটি গারীব। (তিরমিযী শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পঞ্চম খণ্ড, পৃঃ ৫০১, হাদীস ৩২২৯)
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আল্লাহ্‌র ভুল ঢাকতে গিয়ে তাফসিরকার এবং অনুবাদক নিজেদের মনগড়া কথাবার্তা বন্ধনীর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।

একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে, এই ধরনের ইসলামী পরিসংখ্যান কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে—যেখানে শুধু আল্লাহ্ই নন, তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তথা নবী মুহাম্মদেরও পরিসংখ্যান জ্ঞান একেবারেই মূল্যহীন বা অ-নির্ভরযোগ্য।

কোরানের একটি আয়াতে আল্লাহ্‌ আমাদেরকে ইসলামি নরকের আকৃতির ব্যাপ্তি সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা দিয়েছেন।
৮৯:২৩ এবং সেদিন জাহান্নামকে আনা হবে, সেদিন মানুষ স্মরণ করবে, কিন্তু এই স্মরণ তার কি কাজে আসবে? [তফসীর মাআরেফুল কোরআন (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তফসীর), হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শাফী’ (রহঃ), অনুবাদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান]
এই আয়াত নিয়ে সুনান তিরমিযীতে অন্তর্গত একটি হাদিস পড়া যাক।
আবদুল্লাহ্‌ ইব্‌ন আবদুর রহমান (র.)...আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ সেইদিন (কিয়ামতের দিন) জাহান্নামকে আনা হবে। এর থাকবে সত্তর হাজার লাগাম। প্রতিটি লাগামের সাথে থাকবে সত্তর হাজার ফিরিশতা। তারা এটি ধরে তা টানবে।
...আবদুল্লাহ ইব্‌ন আবদুর রহমান বলেনঃ ছাওরী (র.) হাদীছটি মারফূ’ রূপে বর্ণনা করেন নি।
...আবদ ইব্‌ন হুমায়দ (র।)...আলা ইব্‌ন খালিদ (র।) সূত্রে উক্ত সনদে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে এটি মারফূ নয়। (তিরমিযী শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পঞ্চম খণ্ড, পৃঃ ৫৫, হাদীস ২৫৭৪)
এখন গণনা করা যাক, কতজন ফেরেশতা জাহান্নামকে টেনে আনবে—সত্তর হাজারকে সত্তর হাজার দিয়ে গুণ করলে আমরা পাই (গণনাযন্ত্র বা ক্যালকুলেটর ব্যবহার করুন) ৪.৯ বিলিয়ন বা ৪৯০ কোটি ফেরেশতা। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, উনি যা চাইবেন, তা নিমেষেই করে ফেলতে পারেন (২:১১৭)। তাই যদি হয়, তবে এই বিশাল সংখ্যক ফেরেশতার কী প্রয়োজন?

আরও একটি হাদীস দেখা যাক—হাদিসটি ইসলামি স্বর্গসুখের নমুনা।
সুয়ায়দ ইব্‌ন নাসর (র)...আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন। রাসূলুল্লাহ্‌ বলেছেনঃ জান্নাতীদের মাঝে সর্বনিম্ন যে তারও হবে আশি হাজার সেবক, বাহাত্তর হাজার সঙ্গিনী। মোতী, যবরজদ এবং ইয়াকূত পাথরে নির্মিত পাথরে জাবিয়া থেকে সান’আ পর্যন্ত দূরত্বের ন্যায় (১) বিস্তৃত এক বিরাট গুম্বজ বিশিষ্ট প্রাসাদ তার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হবে।
...এই সনদেই নবী (সা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ ছোট বা বড় যে বয়সেই মারা যাক না কেন জান্নাতে গিয়ে তার বয়স হবে ত্রিশ। কখনও তাদের বয়স বাড়বে না। জাহান্নামীদের অবস্থা তদ্রূপ হবে।
...এই সনদে নবী (সা) থেকে আরো বর্ণিত যে, তিনি বলেন, জান্নাতীদের যে তাজ হবে এর সবচে’ নিম্নমানের মোতীটিরও ছটাও পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে যা কিছু সব কিছু উজ্জ্বল করে ফেলবে।
...হাদীছটি গারীব। রিশদীন ইব্‌ন সা;দ (র.)-এর রেয়ায়ত ছাড়া এটি সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা নেই।
পাদটিকা (১): জাবিয়া—দামিশ্‌কের একটি নগর। সানআ—ইয়ামনের একটি শহর। (তিরমিযী শরীফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, পঞ্চম খণ্ড, পৃঃ ৪৯-৫০, হাদীস ২৫৬৪)
আমরা অনেকেই শুনেছি যে, ইসলামি স্বর্গে প্রত্যেক মুমিন বান্দা বাহাত্তরটি স্ত্রী পাবে—যাদেরকে হুরী বলা হয়। যেটা আমরা অনেকেই জানি না, সেটা হচ্ছে—প্রত্যেক মুমিনের বাহাত্তর হাজার (৭২০০০) সঙ্গিনীও থাকবে। এই সব বাহাত্তর হাজার সঙ্গিনীরাও যে যৌনসঙ্গিনী হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা এদেরকে মেয়ে-বন্ধু বা ইসলামি গার্লফ্রেন্ড বলতে পারি। আর লক্ষ্য করতে হবে যে এইসব সংখ্যা হচ্ছে সর্বনিম্ন—এর চাইতে বেশি হবে, কম হবে না। আরও মনে রাখতে হবে যে এই সংখ্যা হচ্ছে সাতটি ইসলামি স্বর্গের সর্বনিম্ন স্তরের স্বর্গের সংখ্যা। 

আসুন, এবার আমরা একটি হিসাব করে নিই। সংখ্যার বিশালতার জন্য সাধারণ গণনাযন্ত্রে বা ক্যালকুলেটরে এই হিসাব হয়তো না-ও করা যেতে পারে।

ধরা যাক, আজকের বিশ্বে মুমিন মুসলিমদের সংখ্যা ১.৫ বিলিয়ন বা ১৫০ কোটি। সংখ্যার বিশ্বস্ততার জন্য আমরা ধরে নিচ্ছি, ১৫০ কোটি মুমিন সবাই সর্বনিম্ন বেহেশত (বা ইসলামি স্বর্গ) পাচ্ছেন। 

যেহেতু এই ইসলামি স্বর্গের সব ফুর্তি শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য, সেই জন্য এই সংখ্যাকে অর্ধেক করতে হবে। অর্থাৎ ৭৫ কোটি মুসলিম পুরুষেই এই ভোগবিলাসে মত্ত থাকবে।

এই সব মুমিনদের সর্বক্ষণ পরিচর্যা বা আরাম-আয়েশের নিমিত্তে আল্লাহ নিয়োজিত করেছেন —

চাকর বা নফর—৮০ ০০০ গুণ ৭৫০ ০০০ ০০০—সংখ্যাটি এত বিশাল যে সাধারণ সংখ্যা লেখার পদ্ধতিতে সংখ্যাটি লিখলে তা হবে এই প্রকারঃ ৬০ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ যা হচ্ছে ৬০ ট্রিলিয়ন (বাংলায় কি হবে আমার জানা নেই, খুব সম্ভবত ৬০ লক্ষ কোটি)।

ইসলামি মেয়েবন্ধু বা গার্লফ্রেন্ড—৭২ ০০০ গুণ ৭৫০ ০০০ ০০০ যার ফল হচ্ছে ৫৪ ০০০ ০০০ ০০০ ০০০ বা ৫৪ ট্রিলিয়ন (বাংলায় খুব সম্ভবত ৫৪ লক্ষ কোটি)।

এ কী বিশাল ইসলামি ভোগসুখের কারখানা, তা আমরা কেউ চিন্তাই করতে পারি না। অন্ততপক্ষে সংখ্যার দিকে এ এক অকল্পনীয় ব্যাপার।

আরও লক্ষণীয় ব্যাপার—ইসলামি স্বর্গে আল্লাহ তা’আলা প্রতি মুমিনের বয়স তিরিশ বছর করে দেবেন। আল্লাহ্‌ মনে করেন, ত্রিশ বছর বয়সে এক মুমিন পুরুষের যৌনকামনা তুঙ্গে থাকে। কিন্তু আল্লাহ পাক মুমিন নারীদের ব্যাপারে কিছু জানাননি।

(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন