বুধবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৬

খায়বার যুদ্ধ - ২০: লুটের মাল ভাগাভাগি -আল কাতিবা অঞ্চল!: কুরানে বিগ্যান (পর্ব-১৪৯): ত্রাস, হত্যা ও হামলার আদেশ – একশত তেইশ

লিখেছেন গোলাপ

(আগের পর্বগুলোর সূচী এখানে)

"যে মুহাম্মদ (সাঃ) কে জানে সে ইসলাম জানে, যে তাঁকে জানে না সে ইসলাম জানে না।"

স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) খায়বারের নিরীহ জনপদবাসীদের খুন, জখম ও বন্দী করে দাস ও যৌনদাসী রূপে রূপান্তরিত করার পর তাঁদের আল-নাটা ও আল-শিইখ অঞ্চলের সমস্ত লুণ্ঠিত সম্পদ কী প্রক্রিয়ায় তাঁর অনুসারীদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করেছিলেন, আদি উৎসে বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকদেরই প্রাণবন্ত বর্ণনার আলোকে তার আলোচনা আগের পর্বে করা হয়েছে।

আদি উৎসে নথিভুক্ত এই সকল অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রাণবন্ত ইতিহাসগুলোকে পরবর্তী প্রজন্মের তথাকথিত মডারেট ইসলাম-বিশ্বাসী পণ্ডিত ও অপণ্ডিতরা (অধিকাংশই না জেনে) তাঁদের নিজেদের সুবিধামত মিথ্যাচার, তথ্য-গোপন ও তথ্য-বিকৃতির মাধ্যমে উপস্থাপন করে যুগে যুগে সাধারণ সরলপ্রাণ অজ্ঞ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করেচলেছেন (পর্ব: ৪৫); কী কারণে তাঁদের এই অসৎ প্রচেষ্টা আজও অব্যাহত আছে ও যতদিন ইসলাম বেঁচে থাকবে, ততদিন তা কী কারণে বলবত থাকবে, তার আলোচনা 'জ্ঞান তত্ত্ব (পর্ব: ১০)’পর্বে করা হয়েছে।

এই ইতিহাসগুলো লেখা হয়েছে মুহাম্মদের মৃত্যু-পরবর্তী সবচেয়ে নিকটবর্তী সময়ে, যা এখনও সহজলভ্য। উৎসাহী পাঠকরা ইচ্ছে করলেই তা বিভিন্ন উৎস থেকে অনায়াসেই খুঁজে নিয়ে প্রকৃত তথ্য জেনে নিতে পারেন। ইসলামকে সঠিকভাবে জানতে হলে "মুহাম্মদ-কে জানতেই হবে!" এর কোনোই বিকল্প নেই। ইসলামে কোনো কোমল, মডারেট বা উগ্রবাদী শ্রেণীবিভাগ নেই! ইসলাম একটিই, আর তা হলো মুহাম্মদের ইসলাম।

আল-ওয়াকিদির (৭৪৮-৮২২ খ্রিষ্টাব্দ) অব্যাহত বিস্তারিত বর্ণনার পুনরারম্ভ: [1]

‘ইবনে ওয়াকিদ বলেছেন: আমাদের মধ্যে আল-কাতিবার বিষয়টি বিতর্কিত; কেউ কেউ বলে: এটির সম্পূর্ণই ছিল আল্লাহর নবীর জন্য, মুসলমানরা এ ব্যাপারে মনক্ষুণ্ণ ছিল না। নিঃসন্দেহে তা ছিল নবীর জন্য। ইবনে ঘুফায়ের-এর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আবদুল্লাহ বিন নুহ, বশির বিন ইয়াসার-এর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মুসা বিন আমর বিন আবদুল্লাহ বিন রাফি, নিজ পিতার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ইবরাহিম বিন জাফর আমাকে বলেছেন যে, এক ভাষ্যকার তাকে বলেছেন, যা তিনি বলেছেন: খায়বারে আল্লাহর নবীর এক-পঞ্চমাংশ হিস্যাটি এসেছিল আল-শিইখ ও আল-নাটা থেকে

আবু বকর বিন মুহাম্মদ বিন আমর বিন হিযাম-এর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কুদামা বিন মুসা আমাকে বলেছেন, যা তিনি বলেছেন: উমর বিন আবদুল আজিজ [৬৮২-৭২০ খ্রিষ্টাব্দ] তার শাসন আমলে আমার কাছে চিঠিতে যা লিখেছিলেন, তা হলো, "আমার জন্য আল-কাতিবা বিষয়টি তদন্ত করো!" আবু বকর বলেছেন: আমি আমরা বিনতে আবদ আল-রহমানকে জিজ্ঞাসা করি, সে বলেছে: বাস্তবিকই যখন আল্লাহর নবী বানু আবি আল-হুকায়েক-এর সাথে শান্তি চুক্তি করেন, তিনি নাটা, আল-শিইখ ও আল-কাতিবা পাঁচটি ভাগে ভাগ করেন। আল-কাতিবা ছিল তারই এক অংশ। আল্লাহর নবী তা পাঁচ "ভাগে ভাগ" করেন ও তা থেকে এক ভাগ আল্লাহর জন্যনির্দিষ্ট করেন। অতঃপর আল্লার নবী বলেন, "হে আল্লাহ, আমি তোমার অংশটি আল-কাতিবা এলাকায় নির্ধারণ করবো।" প্রথমেই যে ভাগটি নির্ধারণ করা হয়, তাতে লেখা ছিল আল-কাতিবা। সুতরাং আল-কাতিবা ছিল আল্লাহর নবীর এক-পঞ্চমাংশ অন্যান্য অংশগুলো চিহ্নিত করা হয়নি।  সেগুলো ছিল মুসলমানদের জন্য আঠারটি ভাগে ভাগ করা। আবু বকর বলেছেন: আমি উমর বিন আবদুল আজিজ-কে এই বিষয়টি লিখে জানাই।"  [3]

হিযাম বিন সা'দ বিন মুহায়েয়িসা হইতে > আবু মালিক হইতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আবু বকর বিন আবি সাবরা আমাকে জানিয়েছেন, তিনি যা বলেছেন: যখন আল্লাহর নবীর অংশটি গ্রহণ করা হয়, আল-শিইখ ও আল-নাটা মুসলমানদের জন্য সমভাবে চার-পঞ্চমাংশ হিস্যার অংশ হিসাবে অধিষ্ঠিত হয়।

সা'ইদ বিন আল-মুসায়েব হইতে > আবু মালিক আল-হিমায়েরি হইতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আবদুল্লাহ বিন আউন; এবং আল-যুহরি হইতে হইতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মুহাম্মদ আমাকে জানিয়েছেন। তারা যা বলেছেন: আল-কাতিবা ছিল আল্লাহর নবীর এক-পঞ্চমাংশ হিস্যার অংশ। তিনি বলেন: আল্লাহর নবী আল-কাতিবা অংশ থেকে খাবার খান ও তা থেকে তাঁর পরিবারের খরচ প্রদান করেন।

ইবনে ওয়াকিদ বলেন: আমাদের সঙ্গে যা নিশ্চিত করা হয়েছে, তা হলো - খায়বারে এটিই ছিল আল্লাহর নবীর এক-পঞ্চমাংশ হিস্যা। আল্লাহর নবী শুধুমাত্র আল-নাটা ও আল-শিইখ থেকেই খাবার খাননি, তিনি সেখানে মুসলমানদের জন্য হিস্যা নির্ধারণ করেন। আল-কাতিবা ছিল সেই স্থান, যেখান থেকে তিনি খাবার খেয়েছিলেন। যা অনুমান করা হয়, তা হলো - আল-কাতিবায় আট হাজার ব্যারেল খেজুর ছিল। তার অর্ধেক ছিল ইহুদিদের জন্য, অর্থাৎ চার হাজার ব্যারেল। আল-কাতিবায় বার্লি বপন করা হয়েছিল ও সেখান থেকে কাটা হয়েছিল তিন হাজার পরিমাপ, যার অর্ধেক ছিল আল্লার নবীর জন্য; অর্থাৎ, দেড় হাজার পরিমাপ বার্লি। সেখানে ছিল খেজুরের বিচি, সম্ভবতঃ যা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল প্রায় এক হাজার পরিমাপ; যার অর্ধেক ছিল আল্লাহর নবীর জন্য। আল্লাহর নবী এই সমস্ত বার্লি, খেজুর ও খেজুরের বিচি থেকে মুসলমানদের দান করেন।'---- [*]

[[*] বানু নাদির (পর্ব: ৫২ ও ৭৫) গোত্র  বানু কেইনুকা গোত্র উচ্ছেদের (পর্ব-৫১)মতই মুহাম্মদ খায়বারের ইহুদিদেরও ভিটে-মাটি থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা রক্ষা পেয়েছিলেন এই শর্তে যে, তাঁরা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের গ্রাস করা “তাঁদেরই জমিতে ফল ও ফসল উৎপাদন” করে উৎপন্ন সেই ফল ও ফসলের অর্ধেকই (৫০ শতাংশ) তাঁদের ভূমির এই নব্য মালিকদের দিয়ে দেবেন। এ বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা "খায়বারে ইহুদিদের পরিণতি!" পর্বে করা হবে।]

মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের (৭০৪-৭৬৮ সাল) বর্ণনা: [2]

'অতঃপর আল্লাহর নবী আল-কাতিবার অংশ, যেটি ছিল খাস উপত্যকায়, তাঁর আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী ও অন্যান্য পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে বণ্টন করেন। তিনি তা প্রদান করেন তাঁর

[১] কন্যা ফাতিমাকে ২০০ লোড [4];
[২] আলীকে ১০০;
[৩] উসামা বিন যায়েদ-কে ২৫০ লোড খেজুর;
[৪] আয়েশাকে ২০০ লোড;
[৬] আবু বকরকে ১০০;
[৭] আকিল বিন আবু তালিবকে ১৪০;
[৮] বানু জাফরকে ৫০;
[৯] রাবিয়া বিন আল-হারিথ-কে ১০০;
[১০] আল-সালত বিন মাখরামা ও তার দুই পুত্রকে ১০০, যার ৪০ ছিল আল-সালিতের নিজের জন্য;
[১১] আবু নাকিকা-কে ৫০;
[১২] রুকানা বিন আবদু ইয়াজিদ-কে ৫০;
[১৩] কায়েস বিন মাখরামা-কে ৩০;
[১৪] তার ভাই আবুল কাসেমকে ৪০;
[১৫] উবায়েদা বিন আল-হারিথের কন্যাদের ও আল-হুসায়েন বিন আল-হারিথের কন্যাকে ১০০;
[১৬] বানু উবায়েদা বিন আবদু ইয়াজিদ-কে ৬০;
[১৭] ইবনে আউস বিন মাখরামা-কে ৩০;
[১৮] মিসতাহ বিন উথাথা ও ইবনে ইলিয়াসকে ৫০;
[১৯] উম্মে রুমায়েথা-কে ৪০;
[২০] নুয়ায়েম বিন হিন্দ-কে ৩০;
[২১] বুহায়েনা বিনতে আল-হারিথ-কে ৩-;
[২২] উজায়ের বিন আবদু ইয়াজিদ-কে ৩০;
[২৩] উম্মে হাকিম বিনতে আল-যুবায়ের বিন আবদুল মুত্তালিবকে ৩০;
[২৪] জুমানা বিনতে আবু তালিবকে ৩০;
[২৫] ইবনে আল-আকরামকে ৫০;
[২৬] আবদুল রহমান বিন আবু বকরকে ৪০;
[২৭] হমানা বিনতে জাহাশ কে ৩০;
[২৮] উম্মুল-যুবায়েরকে ৪০;
[২৯] দুবা'য়া বিনতে আল-যুবায়েরকে ৪০;
[৩০] আবু খুনায়েশ-কে ৩০;
[৩১] উম্মে তালিবকে ৪০;
[৩২] আবু বাসরা-কে ২০;
[৩৩] নুমায়েলা আল-কালবি-কে ৫০;
[৩৪] আবদুল্লাহ বিন ওহাব ও তার দুই কন্যাকে ৯০, যার ৪০ ছিল তার দুই পুত্রের জন্য;
[৩৫] উম্মে হাবিব বিনতে জাহাশ-কে ৩০;
[৩৬] মালকু বিন আবদা-কে ৩০; এবং
[৩৭] তাঁর নিজ স্ত্রীদেরকে ৭০০।

আল্লাহর নামে, যিনি পরম করুণাময় ও অতিশয় দয়ালু। একটি স্মারকলিপি, যা আল্লাহর নবী মুহাম্মদ খায়বারের গমের ব্যাপারে তাঁর পত্নীদের প্রদান করেন। তিনি তাদেরকে বিতরণ করেন ১৮০ লোড। তিনি তাঁর কন্যা ফাতিমাকে প্রদান করেন ৮৫ লোড, উসামা বিন যায়েদ-কে ৪০, আল-মিকদাদ বিন আল-আসওয়াদ-কে ১৫, উম্মে রুমায়েথা-কে ৫। যে ডকুমেন্টটি লিখেছিলেন আব্বাস ও যার সাক্ষী ছিলেন উসমান ইবনে আফফান।'---

ইমাম আবু দাউদের (৮১৭-৮৮৯ সাল) বর্ণনা: [5]

'মুজামমি ইবনে জারিয়াহ আল-আনসারি হইতে বর্ণিত: হুদাইবিয়ায় অংশগ্রহণকারী লোকদের মধ্যে খায়বার বণ্টন করে দেয়া হয়।আল্লাহর নবী (তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হউক) তা আঠারটি ভাগে ভাগ করে দেন। সেনাদলে লোক সংখ্যা ছিল ১৫০০ জন। তদের মধ্যে অশ্বারোহী ছিল ৩০০ জন। তিনি অশ্বারোহী সৈন্যদের প্রদান করেন দুই অংশ, আর পদাতিক সৈন্যদের এক অংশ পরিমাণ।’

ইমাম মুসলিম (৮২১-৮৭৫ সাল) এর বর্ণনা: [6]

'ইবনে উমর হইতে বর্ণিত: খায়বারে উমর একটি জমি উপার্জন করেন। তিনি আল্লাহর নবীর (তাঁর ওপর শান্তি বর্ষিত হোক) কাছে আসেন ও এই বিষয়ে আল্লাহর নবীর পরামর্শ কামনা করেন। তিনি বলেন: হে আল্লাহর নবী, আমি খায়বারে জমি অর্জন করেছি। আমি আমার জীবনে এর চেয়ে বেশি মূল্যবান সম্পদ কখনোই উপার্জন করিনি, অতএব এ দিয়ে আমি কী করবো, সে বিষয়ে আপনি কী আমাকে আদেশ করবেন?  তৎক্ষণাৎ তিনি (আল্লাহর নবী) বলেন: যদি তুমি চাও, জমিটি তুমি অক্ষত রাখতে পারো ও তাতে উৎপাদিত শস্যাদি দান (সাদাকা) করতে পারো। তাই উমর তা দান করেন ও ঘোষণা করেন যে, জমিটি যেন অবশ্যই বিক্রয় অথবা উত্তরাধিকারসূত্রে হস্তান্তর অথবা উপহার হিসাবে প্রদান না করা হয়। অতঃপর উমর তা একনিষ্ঠভাবে দরিদ্রদের জন্য, তার নিকটতম আত্মীয়-স্বজনদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, আল্লাহ ও মেহমানদের জন্য উন্মুক্ত করেন। এর তদারককারী কোনো ব্যক্তি যদি এখান থেকে কোনোকিছু যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ খায়, অথবা তার বন্ধু-বান্ধবদের খাওয়ায় ও (নিজের জন্য) এর পণ্য-সামগ্রী মজুদ না রাখে, তবে তাতে কোনো পাপ নেই। ---'

ইমাম বুখারীর (৮১০-৮৭০ সাল) বর্ণনা: [7] [8] [9]

'উমর ইবনে খাত্তাব হইতে বর্ণিত: যার হাতে আমার জীবন তার কসম, অন্যান্য মুসলমানরা দরিদ্রতায় পতিত হতে পারে এই ভয়ে যদি আমি ভীত না হতাম, আমি যা কিছু গ্রামাঞ্চল জয় করতাম, সেগুলো (জমিগুলো) আমি (যোদ্ধাদের মধ্যে) ভাগ করে দিতাম; এই কারণে যে আল্লাহর নবী খায়বারের ভূমিগুলো বণ্টন করে দিয়েছিলেন। --'

'আয়েশা হইতে বর্ণিত: যখন খায়বার বিজয় সম্পন্ন হয়, আমরা বলি, "এখন আমরা পেট ভরে খেজুর খেতে পারবো।"’

'ইবনে ওমর হইতে বর্ণিত: “আমরা পেট ভরে খেতে পারিনি, যে পর্যন্ত না আমরা খায়বার বিজয় সম্পূর্ণ করেছিলাম।"’

- অনুবাদ, টাইটেল, [**] ও নম্বর যোগ - লেখক।

>>> খায়বারের জনপদবাসীদের পরাস্ত করার পর মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ কী প্রক্রিয়ায় 'খায়বারে লুন্ঠিত সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ' নিজে গ্রহণ করেছিলেন তাঁর অনুসারীদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছিলেন, তা আদি উৎসে মুহাম্মদ ইবনে ইশাক, আল-ওয়াকিদি, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবু দাউদের ওপরে বর্ণিত বর্ণনায় অত্যন্ত স্পষ্ট। আল-নাটা ও আল-শিইখ অঞ্চলে লুণ্ঠিত লুটের মালের ভাগাভাগি বিষয়ে যে-অস্পষ্টতা আমরা আগের পর্বটিতে (পর্ব: ১৪৮) প্রত্যক্ষ করেছিলাম, তার ব্যাখ্যাও আমরা আল-ওয়াকিদির ওপরে বর্ণিত বর্ণনায় খুঁজে পাই। তাঁর এই বিস্তারিত বর্ণনায় যা স্পষ্ট, তা হলো, মুহাম্মদ খায়বারের আল-নাটা, আল-শিইক ও আল-কাতিবা অঞ্চল থেকে লুণ্ঠিত সমস্ত সম্পদ একত্র করার পর তা মোট 'পাঁচটি ভাগে' ভাগ করেন। অতঃপর সেখান থেকে তিনি এক ভাগ "আল্লাহর জন্য"  নির্ধারণ করে প্রথমেই সংরক্ষিত রাখেন। "কে সেই মুহাম্মদের ‘আল্লাহ’, যার জন্য মুহাম্মদ লুটের মালের হিস্যা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন?” - তার আলোচনা "কুরান কার বাণী (পর্ব: ১৪)?"পর্বে করা হয়েছে।

অতঃপর, 'আল্লাহর জন্য' সংরক্ষিত এই ভাগটি মুহাম্মদ নিজে হস্তগত করেন, "আল্লাহর নবীর এক পঞ্চমাংশ অংশ (কুরান: ৮:৪১) হিসাবে। অতঃপর এই লুটের মালের উপার্জন তিনি তাঁর নিজের জন্য, তাঁর স্ত্রীদের জন্য ও তাঁর পরিবার সদস্যদের ভরণ-পোষণ ও সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যয় করেন। এ ছাড়াও তিনি এই লুটের মালের উপার্জন থেকে দান করেন তাঁর অন্যান্য আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, অনাথ-দরিদ্র ও মুসাফিরদের (পর্ব-১৪৬)

আদি উৎসে আল-ওয়াকিদির ওপরে বর্ণিত বর্ণনায় আমরা আর যে-বিষয়টি জানতে পারি, তা হলো, অধিকাংশ ভাষ্যকারের মতে "আল-কাতিবার সমস্ত লুণ্ঠিত সম্পদই ছিল মুহাম্মদের ভাগের অংশ (এক পঞ্চমাংশ)”; এ ছাড়াও কিছু কিছু ভাষ্যকারদের মতে, তিনি আল-নাটা ও আল-শিইখ অঞ্চলের সমস্ত লুণ্ঠিত সামগ্রীর এক-পঞ্চমাংশও গ্রহণ করেছিলেন, তবে আদি উৎসে এই বিষয়টি বিতর্কিত। অধিকাংশ ভাষ্যকারদের মতে, আল-নাটা ও আল-শিইখ অঞ্চলের সমস্ত লুণ্ঠিত সম্পদ ছিল মুসলমানদের জন্য, তাদের চার-পঞ্চমাংশ হিস্যা!

মুহাম্মদের প্ররোচনায় তাঁর যে অনুসারীরা একদা আবিসিনিয়ায় হিযরত করেছিলেন (পর্ব-৪১), তাঁদের অনেকেই ফিরে এসেছিলেন মক্কায়; যার আলোচনা “শয়তানের বানী- প্রাপক ও প্রচারক মুহাম্মদ (পর্ব-৪২)!"পর্বে করা হয়েছে। যারা সেখানে অবশিষ্ট ছিলেন, তাঁদের অনেকেই ফিরে এসে খায়বারে মুহাম্মদের সাথে মিলিত হন, মুহাম্মদের খায়বার বিজয় সম্পন্ন হওয়ার পর। যাদের অন্যতম ছিলেন মুহাম্মদের চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবু তালিব (পর্ব-১২৬) ও তাঁর আর এক বিশিষ্ট অনুসারী আবু হুরাইরা [10]। যেহেতু খায়বারের লুটের মালের হিস্যাদাররা ছিলেন মুহাম্মদের সঙ্গে হুদাইবিয়ায় অংশগ্রহণকারী অনুসারীরা, মুহাম্মদ আবু হুরাইরা-কে খায়বারের লুটের মালের কোন হিস্যা প্রদান করেননি। (বুখারী: ৫:৫৯:৫৪১) [11]

ওপরে বর্ণিত ইমাম মুসলিমের বর্ণনায় আমরা আরও জানতে পারি, ওমর ইবনে খাত্তাব খায়বারে যে ভূ-সম্পদ অর্জন করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি মূল্যবান সম্পদ তিনি তার জীবনে কখনোই উপার্জন করেননি। আর ইমাম বুখারীর ওপরে বর্ণিত বর্ণনায় আমরা জানতে পারি, খায়বার বিজয়ের আগে মুসলমানরা পেট ভরে খেতে পাওয়ার মত আর্থিক সচ্ছলতার অধিকারী ছিলেন না খায়বার বিজয়ের পর মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা এত বিশাল পরিমাণ লুটের মাল ও ভূ-সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন যে, তারা এই উপার্জনের মাধ্যমে পার্থিব সচ্ছলতার অধিকারী হতে পেরেছিলেন। মুহাম্মদের আবিষ্কৃত "'জিহাদ' এর ফজিলত (পর্ব-১৩৫)"এখানেই!

ইসলামী ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকে আজ অবধি প্রায় প্রতিটি ইসলাম বিশ্বাসী প্রকৃত ইতিহাস জেনে বা না জেনে ইতিহাসের এ সকল অমানবিক অধ্যায়গুলো যাবতীয় চতুরতার মাধ্যমে বৈধতা দিয়ে এসেছেন। বিষয়গুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিধায় বাংলা অনুবাদের সাথে আল-ওয়াকিদির মূল ইংরেজি অনুবাদের অংশটিও সংযুক্ত করছি। ইবনে ইশাকের মূল ইংরেজি অনুবাদ ইন্টারনেটে বিনামূল্যে ডাউনলোড লিঙ্ক: তথ্যসূত্র [2]

The detailed narrative of Al-Waqidi (continued): [1]

‘Ibn Wāqid said: It was disputed among us about al-Katība; someone said: [Page 692] It was purely for the Prophet; the Muslims were not troubled about it. Rather, it was for the Prophet. Abdullah b. Nūḥ related to me from Ibn Ghufayr, and Mūsā b. Amr b. Abdullah b. Rāfi from Bashīr b. Yasār, and Ibrāhīm b. Jafar related to me from his father that a sayer said: The fifth of the Messenger of God from Khaybar was from al-Shiqq and al-Naṭā. Qudāma b. Mūsārelated to me from Abū Bakr b. Muammad b. Amr b. izām, who said: Umar b. Abdul Azīz wrote to me during his caliphate saying, “Investigate al-Katība for me!” Abū Bakr said: I asked Amra bt. Abd al-Ramān and she said: Indeed, when the Messenger of God contracted a peace with the Banū Abī l-uqayq he divided Naṭā and al-Shiqq and al-Katība into five parts. Al-Katība was a part of it. The Messenger of God made five “droppings”, and from it he apportioned one dropping for God. Then the Messenger of God said, “O God, I will make your portion in al-Katība.” The first of what came out was that in which it was written al-Katība. So al-Katība was the fifth of the Prophet. The other portions were not marked. They were equal to eighteen shares for the Muslims. Abū Bakr said: I wrote to Umar b. Abd al-Azīz about that.

Abū Bakr b. Abī Sabra related to me from Abū Māik from izām b. Sad b. Muayyia, who said: When the portion of the Prophet was taken out, al-Shiqq and Naṭā constituted four fifths for the Muslims equally. Abdullah b. Awn related to me from Abū Mālik al-Himyarī, from Sa‛īd b. al-Musayyib, [Page 693] and Muammad related to me from al-Zuhrī. They said: al-Katība was the fifth of the Messenger of God. He said: The Messenger of God ate the food from al-Katība and paid his family from it. Ibn Wāqid said: It is confirmed with us that it was the fifth of the Prophet from Khaybar. The Messenger of God did not eat the food of al-Shiqq and al-Naṭā alone, he made them portions for the Muslims. Al-Katība was what he ate from. Al-Katība was estimated at eight thousand barrels of dates. And there was for the Jews half of it, i.e. four thousand barrels. Barley was planted in al-Katība, and three thousand measures were reaped from there, and half of it was for the Prophet, that is, one thousand five hundred measures of barley. There were date stones and perhaps about a thousand measures were gathered, half of which were for the Messenger of God. The Messenger of God gave from all of this barley and dates, and date-stones to the Muslims.’-------

(চলবে)

তথ্যসূত্র ও পাদটীকা:

[1]আল-ওয়াকিদির বিস্তারিত বর্ণনা: “কিতাব আল-মাগাজি”- লেখক:  আল-ওয়াকিদি (৭৪৮-৮২২ খৃষ্টাব্দ), ed. Marsden Jones, লন্ডন ১৯৬৬; ভলুম ২, পৃষ্ঠা ৬৯১-৬৯৩; ইংরেজি অনুবাদ: Rizwi Faizer, Amal Ismail and Abdul Kader Tayob; ISBN: 978-0-415-86485-5 (pbk); পৃষ্ঠা ৩৪০-৩৪১

[2]“সিরাত রসুল আল্লাহ”- লেখক: মুহাম্মদ ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদনা: ইবনে হিশাম (মৃত্যু ৮৩৩ খৃষ্টাব্দ), ইংরেজি অনুবাদ: A. GUILLAUME, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচী, ১৯৫৫, ISBN 0-19-636033-1, পৃষ্ঠা ৫২২

[3] উমাইয়া শাসক খলিফা উমর বিন আবদুল আজিজ (৬৮২-৭২০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন দ্বিতীয় খুলাফায়ে রাশেদিন উমর ইবনে খাত্তাবের নাতি।  তিনি ৭১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন।

Narated By Mujammi' ibn Jariyah al-Ansari: Khaybar was divided among the people of al-Hudaybiyyah. The Apostle of Allah (pbuh) divided it into eighteen portions. The army contained one thousand and five hundredpeople. There were three hundred horsemen among them. He gave double share to the horsemen, and a single to the footmen.

Ibn Umar reported: Umar acquired a land at Khaibar. He came to Allah's Apostle (may peace be upon him) and sought his advice in regard to it. He said: Allah's Messenger, I have acquired land in Khaibar. I have never acquired property more valuable for me than this, so what do you command me to do with it? There upon he (Allah's Apostle) said: If you like, you may keep the corpus intact and give its produce as Sadaqa. So 'Umar gave it as Sadaqa declaring that property must not be sold or inherited or given away as gift. And Umar devoted it to the poor, to the nearest kin, and to the emancipation of slaves, aired in the way of Allah and guests. There is no sin for one who administers it if he eats something from it in a reasonable manner, or if he feeds his friends and does not hoard up goods (for himself). --------

Narrated By 'Umar bin Al-Khattab: By Him in Whose Hand my soul is, were I not afraid that the other Muslims might be left in poverty, I would divide (the land of) whatever village I may conquer (among the fighters), as the Prophet divided the land of Khaibar. But I prefer to leave it as a (source of) a common treasury for them to distribute it revenue amongst themselves.

Narrated By 'Aisha: When Khaibar was conquered, we said, "Now we will eat our fill of dates!"

Narrated By Ibn Umar: We did not eat our fill except after we had conquered Khaibar.’

[10] Ibid “কিতাব আল-মাগাজি”- লেখক: আল-ওয়াকিদি, ভলুম ২, পৃষ্ঠা ৬৮৩; ইংরেজি অনুবাদ: পৃষ্ঠা ৩৩৬; Ibid “সিরাত রসুল আল্লাহ”, পৃষ্ঠা ৫২৬

‘Narrated Abu Huraira: When we conquered Khaibar, we gained neither gold nor silver as booty, but we gained cows, camels, goods and gardens. ----‘

বুদ্ধু বৌদ্ধ ভিক্ষুদ্বয়

বৌদ্ধধর্মের করুণার দেবী (দেবতা-দেবী তো ধর্মেই থাকে, নাকি?) Guanyin-এর মূর্তির কাছে পৌঁছতে এই দুই বুদ্ধু বৌদ্ধ হামাগুড়ি দিয়ে পাড়ি দেবে মাত্র ৫০০ মাইল পথ! (সংবাদটি পুরনো)


শুধু কি তাই? প্রতি তৃতীয় পদক্ষেপ (নাকি হাঁটুক্ষেপ) নেয়ার পর তারা থামবে, তারপর দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে মাথা নোয়াবে।... গাঁড়োল-গবেট-গাণ্ডু ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা...

আরও এক দল বুদ্ধু চলেছে তীর্থযাত্রায়। এদের যাত্রাপদ্ধতিও উৎকট। এ থেকে রেহাই নেই শিশুদেরও...

ভিডিও লিংক: https://youtu.be/5S9ABnRvqDk

মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬

আত্মহত্যার চেষ্টা করা সুন্নত

মমিন ভাই ও বোনেরা, আপনারা কি জানেন যে, আত্মহত্যার উপর্যুপরি উদ্যোগ নেয়া সুন্নত? কারণ ইছলামীর নবী আত্মহত্যার কথা ভেবেছে অনেকবার, চেষ্টাও করেছে আত্মহননের।... স্বীকৃত ইছলামী তথ্যসূত্রগুলো থেকেই এই তথ্য পাওয়া যায়। ভিডিও দেখে নিশ্চিত হয়ে নিন।... বলে রাখা দরকার, ভিডিওটি বানিয়েছেন এক মমিন খ্রিষ্টান। তবে ভিডিওতে খ্রিষ্টধর্মের মহিমা গাওয়া হয়নি এবং সম্পূর্ণভাবে ছহীহ ইছলামী দলিল ব্যবহার করা হয়েছে।

ভিডিও লিংক: https://youtu.be/nmaJJ9-SOgg

যৌবন বিগত, ধর্ম আগত

লিখেছেন উজান কৌরাগ


না-জায়েজ ছবিটাতে সংগীতশিল্পী তিমির নন্দীর পাশে নজরুলসঙ্গীত শিল্পী ফাতেমাতুজ জোহরা; আধুনিক সহি মুসলিম নারী! বেশ কয়েক বছর ধরেই তিনি সহি লাইনে আছেন। আজকাল দেখি আবার নতুন ভেক ধরেছেন মাথায় হিজাব (এটাকে কী বলে?) বেঁধে। ইনিয়ে-বিনিয়ে এমনভাবে কথা বলেন, মনে হয় যেন মাত্রই আল্লাহ্'র সাথে সাক্ষাৎ করে এলেন। অথচ তিনি গান করেন, যা ইসলামে হারাম; ভ্রু প্লাক করেছেন, যা ইসলামে হারাম; মুখে রঙ মেখেছেন, যা ইসলামে হারাম; মুখ বের করে রেখেছেন, যা ইসলামে হারাম; পরপুরুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যা ইসলামে হারাম; ক্যামেরার সামনে বসে গান গেয়েছেন, দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন, যা ইসলামে হারাম!


এক সময় তিনি এলোচুলে, বাহারি সাজে ক্যামেরার সামনে কিংবা খোলা মঞ্চে গান পরিবেশন করেছেন। তখন গান শোনার পাশাপাশি মানুষ তার শারীরিক সৌন্দর্যও অবলোকন করেছে, কিন্তু তখন তিনি মাথায় হিজাব পরেননি। তখন তাঁর যৌবন ছিল, পুরুষেরা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলে সেই বয়সেই হওয়ার কথা; এখন তার যৌবন বিগত, এই বয়সের নারীদেরকে অতি বৃদ্ধরাও বোধহয় খুব কমই কামনা করে, তরুণেরাও শ্রদ্ধা করে; অথচ এখনই তিনি সহি ভেক ধারণ করেছেন। যৌবনে শারীরিক সৌন্দর্য দেখিয়ে, রঙিন লাইটের সামনে কালো চুলের রোশনাই ছড়িয়ে হাজারো পুরুষের সামনে দুলে দুলে গান গেয়ে টাকা কামিয়েছেন, আরাম-আয়েসে বিলাসী জীবন-যাপন করেছেন; আর এখন পড়তি সৌন্দর্য, পক্ককেশ ঢেকে সহি মুসলমানিত্ব জাহির করছেন! একটা পোশাক পরা মানুষের ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার; কে কী পরবে না পরবে তা অন্য কেউ ঠিক করে দিতে পারে না। কিন্তু বেশভূষার কিছু কিছু পরিবর্তন মানুষের ভেতরের ভণ্ডামিকে প্রকট করে তোলে; তখন আর কিছু না বলে মুখ বুজে থাকা যায় না। বাংলাদেশে অধিকংশ মানুষের মধ্যেই এটা একটা কমন ব্যাপার যে, যৌবনে যারা খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, যথেচ্ছ যৌনাচার-ব্যভিচার, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন, অসৎ পথে টাকা রোজগার ইত্যাদি করেছেন, একটা বয়সের পরে এরাই আবার পরম ধার্মিক সেজে ধর্মেকর্মে মন দিয়েছেন বা ধর্মরক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। 

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এখন ফাতেমাতুজ জোহরা স্টাইলটাই চলছে, চলছে নিজেকে সহি মুসলমান প্রমাণের তুমুল প্রচেষ্টা; কি ছেল কি মেয়ে, যৌবন ফুরোলে সবাই সহি মুসলমান! আজকাল শুটিং ইউনিট, থিয়েটার, সঙ্গীত সংগঠন, আবৃত্তি দল ইত্যাদি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে রোজার মাসে কাজ বাদ দিয়ে ইফতার এবং ঘটা করে ইফতার পার্টির হিড়িক পড়ে যায়, যেটা বিশ বছর আগেও এতোটা প্রকট ছিল না। যে নায়িকা কোমর দুলিয়ে, পরপুরুষের বক্ষে পেষিত হয়ে নাচানাচি করে, কিন্তু দিন শেষে সেও ফেইসবুকে পোস্ট দেয় -'ইসলাম শান্তির ধর্ম। নামাজ পড়ুন, রোজা রাখুন।' এইসব ভণ্ড চরিত্রে আজ ভীষণ ভারী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের বুক। 

ভণ্ড ফাতেমাতুজ জোহরার মধ্যে আমি পুরো বাংলাদেশটাকে দেখতে পাই! একাত্তরে জন্ম নেওয়া একটি স্বাধীন-সুন্দর-সৌন্দর্যে ভরপুর বাংলাদেশ মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে ধর্মীয় কলুষতা, সাম্প্রদায়িকতা, হিংস্রতার বিষবাষ্পে পতিত হতে হতে মহাপতনের দিকে ধাবিত হয়েছে। অবাক হবো না, যদি দু'দশক পরে দেখি নারীরা হিজাব পরে সিনেমা করছে, গান গাইছে, আবৃত্তি করছে, মঞ্চে অভিনয় করছে। ভণ্ডামির চূড়ান্ত মঞ্চের দিকে আমরা ধাবিত হচ্ছি। তবে এই ভণ্ডামিও খুব বেশি বছর দীর্ঘায়িত হবে না, কারণ একটা পর্যায়ে হিজাব কেন, বোরখা পরেও নাচতে-গাইতে-অভিনয় করতে দেবে না; গৃহবন্দী হওয়াই এদেশের নারীদের ভবিতব্য। তবু আমাদের বলতেই হবে, ইসলাম শান্তির ধর্ম। আরো শান্তি আসছে, সুদিন আসছে...

* যৌথ ছবিটা তিমির নন্দীর ফেইসবুক ওয়াল থেকে এবং অন্যগুলো গুগল থেকে সংগৃহীত।

বুরকা অ্যান্ড দ্য বিচ – ৩০

বিকিনিবহুল সমুদ্রতীর বা অন্যান্য রৌদ্রস্নানস্থলে বোরখাপরিহিতাদের অবস্থান বড়োই বেমানান, দৃষ্টিকটু, অশোভন এবং অশালীনও বটে। সেখানে তোলা কিছু ছবির সংকলন "বুরকা অ্যান্ড দ্য বিচ" ("বিচ" বানান কিন্তু beach. খিয়াল কৈরা!)।


সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৬

সত্যিকারের ডাইনিদের গল্প - ৩

লিখেছেন সরকার আশেক মাহমুদ

(ছোটবেলার রূপকথার বইতে জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া ভাই-বোনদের ডাইনি বুড়ির খপ্পরে পড়ার কাহিনী আপনারা সবাই হয়ত পড়েছেন। অথবা শুনেছেন হয়ত, ঝাড়ুতে ভর করে কীভাবে কীভাবে জাদুকরী উড়ে যেতে পারে আকাশে। আধুনিক রূপকথার হ্যারি পটারের কাহিনীতেও আমরা জাদুর বলে ঝাড়ুতে ভর করে উড়ে যাবার দৃশ্য দেখতে পেয়েছি। এই গল্পগুলো আমাদের জন্য যতই বিনোদনদায়ক হোক না কেন, এই জাতীয় গল্পের ঐতিহাসিক উৎসস্থলে ফিরে গেলে আমাদের নৃশংসতা আর বর্বরতা দেখে আঁতকে উঠতে হবে। মানুষের অজ্ঞতার যুগে ধর্মান্ধতার বাড়াবাড়ি পশ্চিমা বিশ্বের মানুষকেও কীভাবে ভয়ানক বর্বরতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তা থেকে উঠে আসা পশ্চিমা বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে তুলনা করতে গেলে যা কিনা অভাবনীয় মনে হবে। সেই সাথে আমাদের ভাবতে সাহায্য করে - আমাদের অজ্ঞতা, অন্ধবিশ্বাস এবং অযৌক্তিক ভীতি কীভাবে আমাদের ঠেলে দিতে পারে সহিংসতার দিকে।)

ডাইনি গল্প তিন: অষ্ট্রিয়া 

কোনো ডাইনিকে বাঁচতে দিয়ো না। (বাইবেল, যাত্রাপুস্তক ২২:১৮)

১৬৭৫ সাল থেকে ১৬৯০ সাল ব্যাপী অস্ট্রিয়ার Salzburg-এর একটা ঘটনা। ১৬৭৫ সালে Barbara Kollerin নাম্নী এক মহিলাকে চুরির এবং জাদু করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হল। নির্যাতনের সময় সে স্বীকার করল যে, তার ছেলে Paul Jacob Koller শয়তানের সাথে আঁতাত করেছে এবং তার সঙ্গী এই বিষয়ে স্বীকারোক্তি প্রকাশ করে বর্ণনা করে এবং বলে, জেকব একজন ২০ বছর বয়সের যুবক এবং তার মা তাকে চুরি, ভিক্ষা করা এবং প্রতারণা করা শিখিয়েছে। Barbara Kollerin-কে ১৬৭৫ সালে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং কর্তৃপক্ষ তার ছেলেকে গ্রেফতারের জন্য হুলিয়া জারি করে এবং কালক্রমে এই জেকব Wizard Jackl or Magician Jackl বা Jäckel নামে পরিচিত হয়। (জার্মান - Schinderjackl /"Zaubererjackl")

১৬৭৭ সালে কর্তৃপক্ষ জানতে পারে, Magician Jackl মরে গেছে। তবে তারা ১২ বছর বয়সের (Dionysos Feldner) একজন প্রতিবন্ধী ভিক্ষুককে ধরে আনে, যার নাম দেয়া হয় dirty animal এবং দাবি করা হয় যে, তার সাথে তিন সপ্তাহ আগে জাদুকর Jackl এর দেখা হয়েছিল। অত্যাচারের সময় এই শিশু-ভিক্ষুক বলে যে, জাদুকর Jackl বস্তির একদল গরীব ভিক্ষুক শিশু এবং কিশোরদের নেতা। এবং সে তাদের কালো জাদু শিখিয়েছে। এই খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং গরীব গৃহহীন শিশু-কিশোর ভিক্ষুকদের গণগ্রেফতার শুরু হয়। আর এই অসহায় টোকাইদের ওপরে যতো বেশি অত্যাচার করা হয়, জাদুকর Jackl সম্পর্কে তত বেশি গুজব বাড়তে থাকে। বলা হল, এই জাদুকর অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে এবং ইঁদুরদের ওপর জাদু করে কৃষকদের ফসল নষ্ট করে দিতে পারে। এক পর্যায়ে এটাও বলা হল যে, জাদুকর Jackl একজন খুনি এবং সে এত ভয়ানক যে, তাকে গ্রেফতার করা ঠিক হবে না। সে এক সময় শহরের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত জাদুকর হিসেবে প্রচারিত হয়। যদিও এই কাল্পনিক জাদুকর Jackl-কে কখনই গ্রেফতার করা হয়নি, তবে বিপুল সংখ্যক গরীব শিশু-কিশোরদের ধরে আনা হয় এবং তাদের ওপর আগের বছরের খারাপ আবহাওয়ার জন্য দোষারোপ করা হয়।

সর্বমোট ১৩৯ জনকে হত্যা করা হয় জাদুকর Jackl-এর অনুসারী অভিযোগ দিয়ে। তাদের মধ্যে ৩৯ জন শিশু ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী। ৫৩ জন ১৫-২১ বছর বয়সী। ১১৩ জন পুরুষ, বাকিরা নারী। witchcraft বিচারের কলঙ্কজনক ইতিহাসে এটা ছিল অস্বাভাবিক একটি অধ্যায়, কারণ অধিকাংশ ছিল ভুক্তভোগী ছিল পুরুষ। সবচেয়ে কম বয়সের Hannerl ছিল ১০ বছর বয়সী এবং সবচেয়ে বেশি বয়সের ছিল Margarethe Reinberg ৮০ বছর বয়সী।

প্রথমত, তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নির্যাতন করা হয়েছে এবং আগুনে পোড়ানো হয়েছে। কিছু সংখ্যক মানুষকে জীবন্ত জ্বালানো হয়েছে মৃত্যু নিশ্চিত করা পর্যন্ত। কাউকে কাউকে ফাসি দেয়া হয়েছে, কারো কারো গলা কেটে ফেলা হয়েছে। কারো কারো হাত কেটে জ্বলন্ত লোহা দিয়ে পোড়ানো হয়েছে।

জার্মান কবি Friedrich Spee বলেছিলেন “... If all of us have not confessed ourselves witches, that is only because we have not all been tortured." কিন্তু Spee এই উপসংহারে নিজে নিজে উপনীত হননি। তার এক বন্ধু ছিলেন Duke of Brunswick, যিনি ডাইনি বলে অভিযুক্ত এক নারীকে শৈল্পিক উপায়ে নির্যাতন এবং জেরার ব্যবস্থা করছিলেন তাঁর উপস্থিতিতে। ঐ নারী তখন বলতে শুরু করে যে, সে দেখেছে যে Spee নিজে তাঁর আকৃতি পরিবর্তন করে নেকড়ে, ছাগল এবং অন্যান্য পশুতে পরিবর্তিত হযেছে এবং ডাইনীদের সাথে মিশে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য শিশু, যাদের মাথা ব্যাঙের মতো এবং পা গুলো মাকড়শার মতো। Spee আসলেই বিশ্বস্ত বন্ধুর সান্নিধ্যে ছিলেন বলে তাকে অভিযুক্ত হতে হয়নি। আর তাই তড়িঘড়ি করে তিনি ১৬৩১ সালের বই Cautio Criminalis রচনা করেন, যেখানে তিনি উল্লেখ করেন ডাইনি বিচার কেন বস্তুত অবিচার ও তা অন্যায্য। Spee ছিলেন প্রথম সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, যিনি ডাইনী স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে নির্যাতনের সমালোচনা করেও পার পেয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর আগে এই রকম বিচার প্রক্রিয়ায় সন্দেহপোষনকারীদের ওপর জাদুকরী এবং ডাইনি-বাজির অভিযোগ এনে হত্যা করা হয়েছিল । 

বার্ট্রান্ড রাসেল যেমনটা বর্ণনা করেছেন: “কিছু কিছু সন্দেহবাদী সাহস করে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল - এই ঝড়, বজ্রপাত কিংবা শিলাবৃষ্টি কীভাবে কোনো নারীর কারসাজিতে হতে পারে? এই ধরনের প্রকাশ্যে সন্দেহবাদীদের রেহাই দেয়া হয়নি। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে University of Treves এর রেক্টর জনাব Flade, যিনি কিনা প্রধান বিচারক হিসেবে অসংখ নারী ডাইনি অভিযুক্ত করে শাস্তি দিয়েছেন, একটা পর্যায়ে বলে বসলেন, হয়তো এই নারীরা নিজেদের ডাইনি হিসেবে স্বীকার করেছে তাদের ওপর করা অসহ্য অত্যাচার সহ্য করতে না পারার কারণে। কিন্তু ধর্মীয় রীতিসম্মত বিচারপন্থার ওপর সন্দেহ আরোপ করার জন্য এই বিচারকের ওপর অভিযোগ আনা হল যে, তিনি তাঁর আত্মাকে শয়তানের কাছে বেচে দিয়েছেন। তারপর Flade-কে অত্যাচারের সাথে জেরা করা শুরু করা হল স্বীকারোক্তি আদায় করা পর্যন্ত। ১৫৮৯ সালে তাঁকে ফাঁসি দিয়ে তারপর আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়।” (B. Russell, Religion and Science (1935; reprint, Oxford: Oxford Univ. Press, 1997), 95.)

ক্যাথলিক চার্চ ১৮১৬ সালে Pope Pius VII-এর সময়ে অবশেষে এই নির্যাতন-প্রক্রিয়াকে সর্বপ্রথম অফিশিয়ালি নিন্দা প্রকাশ করে।

যেসব আবহাওয়াগত প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা রোগ-শোক বা অকস্মাৎ মৃত্যুর কারণে জাদুকর বা ডাইনিদের অভিযুক্ত করা হতো, বর্তমান কালে বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে তার অনেক কিছুই মানুষ জানে ও বোঝে। কিন্তু অজানা ও অনিশ্চয়তার কারণে ধর্মীয় রীতিতে মানুষহত্যা বা নির্যাতন কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদেরকে বিজ্ঞানভিত্তিক যৌক্তিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে। আদিম যুগে মূর্খদের রচিত কোনো পরস্পরবিরোধিতাময় বাণী সম্বলিত ধর্মগ্রন্থের মধ্যে সবকিছুর উত্তর আছে ভেবে নিলে হানাহানি চলতেই থাকবে এবং সভ্যতা ও পৃথিবীর অগ্রগতি অসম্ভব হয়ে পড়বে।

দ্বীনবানের দীন বাণী - ৫০

ভিডিওসূত্র: https://youtu.be/UhQuUSNkxRM?t=4m18s

প্রাসঙ্গিক জ্ঞাতব্য: পৃথিবীর ওজন 6,000,000,000, 000,000,000,000,000 কিলোগ্রাম। এবং একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গড়পড়তা ওজন ৬২ কিলোগ্রাম।

পুতুলের হক কথা - ২৫

লিখেছেন পুতুল হক

৯৭.
ইবনে ইসহাক রচিত সিরাতে রাসুলুল্লাহ মুসলিম সমাজে রাসুলের জীবনচরিত হিসেবে খুবই সমাদৃত বই। মুসলিম পণ্ডিতগণ বিভিন্ন সময়ে এই বই রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন। এই বইয়ের একটি ঘটনা বলছি।

সুহাইলি, রর.৭৯: ইউনুছের রেওওয়ায়েত কর্তৃক রেকর্ডকৃত: 
নবী তাঁকে (উম আল-ফজলকে) দেখেন যখন সে তাঁর সামনে হামাগুড়ি দিচ্ছিল। তিনি বলেন,-‘যদি সে বড় হয় এবং আমি তখনও বেঁচে থাকি, আমি তাঁকে বিয়ে করবো’; কিন্তু সে বড় হবার আগেই নবী ইন্তেকাল করেন এবং সুফিয়ান বীণ আল-আসওয়াদ বীণ আব্দুল আসাদ আল-মাখজুমির সাথে তাঁর বিয়ে হয় এবং সুফিয়ানের ঔরসে রিজক এবং লুবাবা নামে দুটি সন্তান জন্মে। (পৃষ্ঠা নং ৩১১)
পাক্কা মুসলিমের কাছে আমাদের হামাগুড়ি দেয়া শিশুরাও নিরাপদ নয়। এইসব বাচ্চাদের দেখে মুমিনের অন্তরে যৌনক্ষুধা জাগে। তবে বেচারি উম আল-ফজলের ক্ষেত্রে মহানবী উদারতা দেখিয়েছেন, কারণ তিনি ইচ্ছে করলে তৎক্ষণাৎ তাঁকে বিয়ে করতে পারতেন। ইসলামে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা দুগ্ধপোষ্য শিশুদের বিয়ে করতে পারে। 

এখন আধুনিক মুসলমান যদি বলে যে, এসব প্রাচীন ঘটনা, এখন আর এমন হয় না, তাহলে কিন্তু একটা কথা আসে। কোরআনকে সর্বকালের জীবনবিধান আর রাসুলের হাদিস যদি হয় চিরদিনের জন্য অনুকরণীয়, তাহলে এসব অবশ্যই ঘটবে। কোরআন আর হাদিস অনুযায়ী এক সহি মুসলমানের ইসলামিক বাংলাদেশের স্বপ্ন কি তারা দেখেন না? তারা কি চান না এই দেশে ইসলামী আইনের শাসন? রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যদি ইসলাম আসে তাকে কি কেটে-ছেঁটে বনসাই করে রাখবেন? তা কী করে সম্ভব! আল্লা কি তার অনুমতি দিয়েছে?

৯৮.
এক পরহেজগার আপাকে তার হাবি সুরা নিসা আয়াত পড়ে শোনায়। আপা পাল্টা আয়াত তন্নতন্ন করে খোঁজে কোরানে। আছে কি এমন কোনো আয়াত, যেটা আপার উপকারে আসবে?

৯৯.
দিকে দিকে মুমিনারা শরিয়া আইনের জয়গান গাইছে শুনি। এতো সম্মান তারা রাখবে কই? এই আইনের প্রয়োজনীয় কিছু দিক তুলে ধরি:

১) স্ত্রীর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের জন্য দরকারি বস্তুসমূহ: স্ত্রী তার কেশবিন্যাসের জন্য তেল, শ্যাম্পু, সাবান, চিরুনি পাবে। (যা সেই শহরে সচরাচর ব্যবহার হয়) স্বামীকে তার স্ত্রীর বগলের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য যে সুগন্ধির প্রয়োজন, তা দিতে হবে। যৌনসঙ্গমের পূর্বে ও পরে স্ত্রীর গোসলের যে পানি দরকার, তা স্বামীকে দিতে হবে। সন্তানপ্রসবের পরে রক্ত ধৌত করার জন্য যে পানির প্রয়োজন, তাও স্বামীকে দিতে হবে। এই দু'টি কারণ ছাড়া স্বামী তার স্ত্রীকে সাধারণ গোসল অথবা ধৌতের জন্যে যে পানির প্রয়োজন, তার খরচ দিতে বাধ্য থাকবে না।

২) স্বামী তার স্ত্রীর প্রসাধন সামগ্রী, চিকিৎসকের খরচ, ঔষধের খরচ অথবা এই ধরনের অন্যান্য খরচ বহন করতে বাধ্য থাকবে না, যদিও স্বামী চাইলে তা করতে পারে। এটা শুধু সুপারিশ, বাধ্যবাধকতা নয়। কিন্তু শিশু জন্মের সাথে জড়িত খরচ স্বামীকে বহন করতে হবে।

৩) দৈনিক ভাতা শুরু হবে দিনের শুরুতে। স্বামী তার স্ত্রীকে দিনের প্রথমে স্ত্রীর দৈনিক ভাতা দিতে বাধ্য থাকবে। মরশুমের শুরুতেই স্বামী তার স্ত্রীকে পোশাকের কাপড় দিয়ে দেবে।

৪) স্ত্রীর ভরণপোষণ স্বামী সে পর্যন্তই বহন করবে, যে পর্যন্ত চাহিবার মাত্র স্ত্রী তার স্বামীকে দেহদান করে অথবা দেহদানের প্রস্তুতি দেখায়। এর অর্থ হচ্ছে স্ত্রী স্বামীকে পূর্ণ যৌন-উপভোগ করতে দিবে এবং কোনো অবস্থাতেই স্বামীর যৌন চাহিদার প্রত্যাখ্যান করবে না। স্বামীর ভরণপোষণ স্ত্রী পাবেনা যখন:
- স্ত্রী স্বামীর অবাধ্য হবে, তার মানে যখন স্ত্রী স্বামীর আদেশ অমান্য করবে এক মুহূর্তের জন্যে হলেও।
- স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে ভ্রমণে যায় অথবা স্বামীর অনুমতি নেয়, কিন্তু ভ্রমণ করে নিজের প্রয়োজনে।
- স্ত্রী হজ্জ অথবা ওমরা করার উদ্দেশ্যে এহরাম করে।
- স্ত্রী যদি স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে নফল রোজা রাখে।

শিশুশিকারী ধর্মগুলো

ঘোর শৈশবেই শিশুদের ওপরে ধর্ম চাপিয়ে না দিয়ে এবং তাদের মগজধোলাই না করে তাদেরকে ধর্মসংশ্লেষমুক্ত শৈশব-কৈশোর পার করার সুযোগ দিয়ে কেবল প্রাপ্তমনস্ক হবার পর সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় কোনও ধর্ম বা ধর্মে-অবিশ্বাস বেছে নিতে বলার মুরোদ কোনও ধর্মেরই নেই। কারণ ধর্মগুলো খুব ভালো করেই জানে, এর ফলে তাদের আশু বিলুপ্তি অনিবার্য হয়ে উঠবে। 

বিশ্বাসের দরজায় করাঘাত!: পর্ব ০৮ – (গ-তে গান, ব-তে বাজনা!)

লিখেছেন নরসুন্দর মানুষ


বছর তিনেক আগের ঘটনা। এক লালন-ভক্তের সাথে আড্ডা হচ্ছিলো; দারুণ তাঁর গানের কন্ঠ, ‘মিলন হবে কত দিনে’- বলে যখন গলায় টান দিচ্ছিলেন, বুকের ভেতরটা হু-হু করে উঠেছিলো! আর যখন শুনি ‘জাত গেলো, জাত গেলো বলে এ কি আজব কারখানা’, তখন লালনের প্রশংসা করতে ইচ্ছে করে। চা-সিঙ্গারা-একতারা আর গানে যখন আসর সরগরম, তখনই মাগরিবের আজান দিয়ে দিলো। 

লালন-ভক্ত বলে উঠলেন, ‘ভাই ২০ মিনিটের একটা ব্রেক নিয়ে নামাজটা পড়ে আসি!’ 
আমি বেদ্বীন-কাফের মানুষ বলে উঠলাম, ‘এতক্ষণ হারামের চর্চা করে নামাজ পড়লে সেটা কি কবুল হবে?’ 

লালন-ভক্তের ক্ষোভের কারণ হয়ে গেলাম সাথে সাথেই। আমার ইসলামী জ্ঞান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বললেন, ‘কে বলছে গান-বাজনা হারাম! আপনাকে তো যথেষ্ট বুঝদার বলেই জানতাম। কী প্রমাণ দিতে পারবেন হাদিস-কোরআন থেকে?’ 

আমি বললাম: ‘দেখুন, যেহেতু এই গবেষণা নিয়েই সময় কাটে বেশির ভাগ, পকেটেই সকল বিষয়ের সকল প্রমাণ থাকে সবসময়; আপনি নামাজ পড়ে আসুন!’

তারপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত: মোবাইলে হাদিস-কোরআন-তাফসীর সহ প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্রের সংগ্রহ থাকে সবসময়ই, সেখান থেকে তাঁকে যা দেখিয়েছিলাম, তাই আজ আপনাদের দেখাবো।

কোরআনে আছে: ‘মানুষের মাঝে কেউ কেউ এমন আছে, যে আল্লাহর রাস্তা (ইসলাম) হতে বিচ্যুত করার জন্য অসার কথাবার্তা (গান-বাজনা) খরিদ/সংগ্রহ করে’ (সূরা লোকমান, আয়াত ৬): সাহাবী ইবনে মাসঊদ, আল্লাহর কসম করে বলেছেন, উক্ত আয়াতে ‘অসার কথাবার্তা’ বলতে গানকে বুঝানো হয়েছে। [১]

নবী মুহাম্মদ বলেছেন,
‘অবশ্যই আমার উম্মতের মধ্যে এমন অনেক গোষ্ঠী হবে,
যারা স্বাধীন মানুষের কেনা-বেচা, রেশম ব্যবহার, মদ ও বাদ্যযন্ত্রকে হালাল গণ্য করবে’। [২]

নবী মুহাম্মদ আরও বলেছেন,
‘অবশ্যই এই উম্মতের মধ্যে ভূমিধ্বস, আসমান থেকে নিক্ষিপ্ত গযব 
ও দৈহিক রূপান্তরের শাস্তির প্রাদুর্ভাব দেখা দিবে। 
এসব তখনই ঘটবে যখন তারা মদ্যপান শুরু করবে, গায়িকা রাখবে ও বাদ্যযন্ত্র বাজাবে’। [৩]

নবী মুহাম্মদ ঢোল-তবলা বাজাতে নিষেধ করেছেন। [৪]
এবং বাঁশিকে দুষ্ট লোক ও বোকার কণ্ঠস্বর নামে আখ্যায়িত করেছেন। [৫]

ইসলাম অনুসারে অসার ক্রীড়া-কৌতুক, গান-বাজনা এবং তাতে ব্যবহৃত যন্ত্রাদি হারাম; যেমন- তানপুরা, সারেঙ্গি, মন্দিরা, বাঁশি, তবলা, বেহালা, একতারা, দোতারা, হার্প, পিয়ানো, গিটার, ম্যান্ডোলিন ইত্যাদি।

এমনকি কোরআন-হাদীসে নিষিদ্ধ তৎকালীন বাদ্যযন্ত্র থেকে বর্তমানের যন্ত্রগুলো বেশি মোহ ও তন্ময়তা সৃষ্টি করে। এমনকি বাদ্যযন্ত্রের নেশা মদের নেশা থেকেও অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায়। আর যদি বাদ্যযন্ত্রের সাথে গান ও সুর সংযোজিত হয় তাহলে পাপের পরিধি বেড়ে যায়, হারামও কঠিন হয়। সেই সাথে গানের কথাগুলি যদি প্রেম-ভালবাসা, রূপচর্চা, যৌন-উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী বিষয়ে হয়, তাহলে তো কথাই নেই।

তবে আপনার মত সুবিধাবাদীরা বলেন: গান দ্বারা যদি আল্লাহ ও রাসূলের প্রশংসা করা হয়, জিহাদের প্রতি অনুপ্রাণিত করা হয়, ইসলামের অনুশাসন মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করা হয়, চরিত্র গঠনের চেষ্টা করা হয়, পাপ-পঙ্কিলতা থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়, তাহলে বাদ্যযন্ত্রবিহীন এ জাতীয় গান বৈধ। যদিও এটা মেনে নেওয়া মানে পানিতে নেমে না ভিজেই গোসল সেরে উঠতে পারা! 

আমি আমার প্রমাণ দিলাম, এবার আপনি প্রমাণ করুন, কোরআন-হাদীস অনুসারে - গ-তে গান, ব-তে বাজনা হালাল।

তাঁর সাথে আমার দেখা হয়নি আর, তবে গান-বাজনাপ্রিয় মুমিন-মুসলিম ভাই-বোনদের কাছে প্রশ্নটা করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না আজ! 

প্রমাণ দেখান, গান-বাজনা হালাল; কারণ আপনার মত গান-বাজনা আমারও প্রিয়!

তথ্যসূত্র:
[১]. তাফসীরে ইবনু কাছীর ৬/৩৩৩ পৃষ্ঠা।
[২]. বুখারী; মিশকাত হাদীস/৫৩৪৩।
[৩]. তিরমিযী হাদীস /২১৮৫; সিলসিলা ছহীহাহ হাদীস /২২০৩।
[৪]. বায়হাক্বী, মিশকাত হাদীস /৪৫০৩; ছহীহুল জামে হাদীস/১৭৪৭-৪৮।
[৫]. তিরমিযী হাদীস /১০০৫; ছহীহুল জামে হাদীস /৫১৯৪। 

(চলবে)

সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব ১৪)


ব্যথা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমি উড়ছি, অতিক্রম করছি ব্র‏হ্মপুত্র, পদ্মা, ভাগীরথী, গঙ্গা, যমুনা আরও কতো শত নদ-নদী ও জনপদ; উড়ে যাচ্ছি আরো অতীতের দিকে, নিগূঢ় শেকড়ের সন্ধানে। পাহাড়, সমভূমি, মরুভূমির ওপর দিয়ে অনবরত উড়ে চলেছি আমি এক মুক্ত হলদে পাখি, দু'ডানায় ক্লান্তি ভর করলে জিরিয়ে নিচ্ছি কোনো পাহাড়ি ঝিরির পাশের তেঁতুল কি হরিতকী কিংবা নাম-না-জানা কোনো বৃক্ষশাখায় বসে, ঝিরির জল পান ক’রে তৃষ্ণা মিটাচ্ছি; কখনো বা বসছি কোনো নদীর পারের বটবৃক্ষের ডালে, নিচে নেমে ঠোঁট ডুবিয়ে আকন্ঠ পান করছি নদীর জল; রাজস্থানের তপ্ত মরুভূমির কোনো কিনারের পাথর চুইয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা জলে দূর করছি বুকের খরা। তারপর আবার উড়ছি, কেবলই উড়ছি অতীতের দিকে। উড়তে উড়তে সিন্ধু নদী পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ৭১৩ খ্রিষ্টাব্দের বসন্তে সিন্ধু রাজ্যের দেবল বন্দরে। বন্দর সংলগ্ন এলাকায় এক পাক উড়ে এসে বসলাম বন্দরের কাছের এক পুরাতন উঁচু অশ্বত্থের মগডালে, এখনো কোথাও কোথাও রয়েছে ধ্বংসের চি‎‎হ্ন; গত বছর জুন মাসে ব্রাহ্মণ রাজা দাহিরকে পরাজিত ক’রে দেবল নগরী দখল করেছে মোহাম্মদ বিন কাশিম। আমি উড়াল দিলাম নগরীর ভেতরের দিকে; কোথাও ঘরবাড়ির পোড়া কাঠামো, কোথাও বড় বড় প্রসাদ কিংবা মন্দিরের ধ্বংসস্তুপ চোখে পড়লো; কোথাও পুরাতন প্রাসাদের জায়গায় তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন ইমারত, মন্দিরের জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে মসজিদ এবং উঁচু মিনার। আমি একটি পিপুলগাছে বসে দেখলাম, এক জায়গায় বিশাল একটি মন্দির ধ্বংস করার পর সেই মন্দিরের পাথর এবং অন্যান্য মাল-মসলা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিশাল মসজিদ। ভারতীয় নব্য মুসলমান ক্রীতদাস কারিগররা ত্রস্ত হয়ে ব্যস্ত হাতে মসজিদ নির্মাণের কাজ করছে; নিকট অতীতে এদের কাউকে অজিত থেকে আজিজ, কাউকে নকুল থেকে কবিরুল করা হয়েছে। আজিজ-কবিরুলদের বিশ্রামের কোনো সুযোগ নেই, যেন বা নেই ক্ষুধা-তৃষ্ণাও! কেবল কাজ করার জন্যই তাদের জন্ম হয়েছে, এক মনে তারা কাজ করছে। অপেক্ষাকৃত উচ্চ মর্যাদার আরব ক্রীতদাসরা চাবুক হাতে তাদের ওপর নরজদারি করছে। তারপরও সামান্য কোনো ভুল-ত্রুটি হলেই আরব ক্রীতদাসদের চাবুক আছড়ে পড়ছে তাদের পিঠে, তাদের মাথা ঠুকে দিচ্ছে দেয়ালে। মাটিতে ফেলে কাউকে কাউকে পা দিয়ে পিষছে তাদের কওমের ভাইয়েরা!

আমি নগরীর রাস্তায় নেমে নব্য মুসলমানের বেশে গায়ে আলখাল্লা-মাথায় পাগড়ি প’রে হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমার সামনে পড়লো একটি ক্রীতদাসের বহর; আমি পথ ছেড়ে দাঁড়ালাম একটা গাছের আড়ালে। চামড়ার ফিতা দিয়ে ক্রীতদাসদের হাত পিছমোড়া ক’রে বাঁধা, আবার কারো কারো হাতে-পায়ে লোহার বেড়ি ও শেকল পরানো! তাদের মধ্যে নারী এবং পুরুষ উভয়ই আছে, আছে অল্পবয়সী বালক-বালিকা ও শিশু। শরীরে জীর্ণ-শীর্ণ পোশাক; শরীরের অনাবৃত অংশে চাবুকের লালচে লম্বা দাগ। সকলেই ক্লান্ত, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর; অপেক্ষাকৃত দুর্বলরা খুব কষ্টে দলের অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটছে চাবুকের ঘা খেতে খেতে, অশ্রুশূন্য শুষ্ক তাদের চোখ, গালে ময়লা কাটা শুকনো অশ্রুরেখা। চাবুক হাতে তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে কয়েকজন অশ্বারোহী আরব মুসলমান; তাদের কথায় কান পেতে বুঝলাম, যাত্রাপথে এই বহরটির সাথে আরো কয়েকটি বহর যোগ হবে। তারপর একত্রিত বিশাল বহরটিকে নিয়ে যাওয়া হবে প্রথমে বাগদাদে, কিছু বিক্রি করা হবে বাগদাদের দাসবাজারে; অবশিষ্ট দাসদের পাঠানো হবে দামেস্কে।

টানা দু'দিন আমি কখনো মুসলমানের বেশে কখনো বা হলদে পাখি হয়ে দেবল নগরীতে ঘুরে বেড়ালাম আর প্রত্যক্ষ করলাম মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট। সর্বত্রই প্রায় একই রকম দৃশ্য; কোথাও ক্রীতদাসরা ধাতু কারখানায় অস্ত্র এবং বর্ম তৈরি করছে, কোথাও তৈরি করছে সোনা-রূপা-তামার অলঙ্কার, কোথাও মাঠ থেকে ফসল কেটে এনে প্রক্রিয়াজাত করছে, কোথাও বস্ত্র কিংবা নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি তৈরি করছে, কোথাও খনন করছে কিংবা ভারী বস্তু বহন করছে; আর সবখানেই তাদের ওপর নজরদারি ও নিপীড়ন করছে আরবরা। সর্বত্রই একই রকম নিপীড়ন ক্রীতদাসদের ওপর। কোথাও কোথাও নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে মানসিকভাবে দুর্বল কোনো ক্রীতদাস আত্মহত্যাও করছে। এই জনপদে মানুষের দুঃখগাথা ব্যতিত যেন কিছু নেই! ভারতীয়দের মুখে কোনো হাসি নেই, জীবনে কোনো সুখ-আনন্দ নেই; নিজের জীবনটাও তাদের নিজের নেই। সকলেই যেন অপরের জীবনের বোঝা বয়ে চলেছে, আপন দেহের ভেতরে আপনিই নেই! 

উড়তে উড়তে আমি এক সাধারণ যোদ্ধার অন্দরমহলের বারান্দার রেলিংয়ের ওপর গিয়ে বসলাম। যোদ্ধা বাড়িতে নেই; আছে দামী রত্ন ও স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিত তার চারজন পত্নী সাধারণ বেশভূষায় ছয়জন ভারতীয় ধর্মান্তরিত যৌনদাসী, তিনজন সুদর্শন বালক ক্রীতদাস আর একজন বালকের মতো দেখতে কিন্তু তার সাজগোজ অনেকটা নারীদের মতোই। বাড়িতে বিপুল বিত্ত-বৈভব। বাড়ির বাইরের মহলে পাহাড়ায় রয়েছে বল্লম হাতে তিনজন ক্রীতদাস। একজন সাধারণ যোদ্ধার এতো দাস-দাসী, বিত্ত-বৈভব; তাহলে আরো বড় যোদ্ধাদের না জানি কী অবস্থা! আমি একজন বড় মাপের ঘোরসওয়ার যোদ্ধার বাড়ির আমগাছে গিয়ে বসলাম। আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল দেখে; দামী আসবাপত্র, বাসন-কোসন, পত্নী, দাস-দাসীর যেন অভাব নেই! এরপর আমি সেনাপতির বিশাল প্রাসাদের এদিক-সেদিক উঁকি দিলাম; অসংখ্য পত্নী, যৌনদাসী আর দাস-দাসীর বহর দেখে আমার বেঁহুশ অবস্থা! এলোমেলোভাবে উড়তে লাগলাম যোদ্ধা আর পদস্থ আরবীয়দের বাড়ির ওপর দিয়ে। একটা ব্যাপার আমাকে বিস্মিত করলো, ঋতুবতী নারী মাত্রই গর্ভবতী; তা সে বয়স বারো হোক কিংবা বায়ান্ন, পত্নী কিংবা দাসী! একসঙ্গে এতো নারী গর্ভবতী হবার কী রহস্য! পত্নীরা অন্দরমহলে উঁচু পেট নিয়ে হাঁটছে, খাচ্ছে, দাস-দাসীদের সেবা গ্রহণ করছে; দাসীরা উঁচু পেট নিয়ে মালকিনের সেবা এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম করছে!

উড়ে যাবার সময় একটা বাড়ির জানালায় চোখ পড়তেই আমি ফিরে এসে বসলাম জানালা থেকে সামান্য দূরত্বের একটা পেয়ারা গাছের ডালে, ঘরের ভেতর জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছেন খোলা চুলের বছর চল্লিশের এক নারী; পরনে সাদা শাড়ি, গায়ে কিছু নেই। বুকে শাড়ির আগল থাকলেও অনাবৃত তার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ চিকন বাহু আর স্ফীত পেট, যথারীতি তিনিও গর্ভবতী! আমি তাঁর চোখ চিনি, চিনি তার চোয়াল আর চুল; তিনি আমার মায়ের পূর্বসুরি! তার সঙ্গে কথা বলার উদগ্র বাসনায় আমি পেয়ারা গাছ থেকে ভূমিতে নামতে যাব এমন সময় আমাকে হতাশ ক’রে এক যুবতী এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেল অন্য কক্ষে। আমি এদিকে-ওদিকে উঁকি দিয়েও তাকে আর দেখতে পেলাম না। কিন্তু দেখা যে আমাকে করতেই হবে, আবার কখন তাকে একা পাব, সেই অপেক্ষায় এগাছ-ওগাছ করছি। এমন সময় চোখ পড়লো এই বাড়িরই পিছন দিকের বাগানে, একজন প্রৌঢ় শীতলপাটিতে বসে সামনের জলচৌকির ওপর ঝুঁকে কিছু লিখছেন আর বারবার কালির পাত্রে কলম চুবিয়ে নিচ্ছেন। পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে পাখার বাতাস করছে এক সুদর্শন কিশোর, আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, কিশোরটি প্রৌঢ়ের ক্রীতদাস। আমি উড়ে গিয়ে বসলাম তাদের মাথার ওপরের কাঁঠাল গাছের ডালে। প্রৌঢ় একটু পরপর কালির পাত্রে কলম চুবিয়ে উটের চামড়ায় একমনে লিখছেন। এখন বসন্তকালের শুরু, এলোমেলো বাতাস বইছে, তেমন গরম লাগছে না, তবু কিশোর অনবরত তার মনিবকে বাতাস ক’রে চলেছে। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি প্রৌঢ়কে; দুধে আলতা তার গায়ের রঙ, দাড়ি-গোঁফের আশি ভাগই সাদা, মাথায় সাদা পাগড়ি, গায়ে সাদা আলখাল্লা। কিছুক্ষণ পর বেশ তৃপ্তির সঙ্গে কলমটি রেখে আবৃত্তি করতে লাগলেন নিজের ছন্দবদ্ধ লেখাগুলো। বুঝলাম যে, তিনি একজন কবি। পর পর কিছু পংক্তি আবৃত্তি করার পর তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, দারুণ উদ্যম আর উচ্ছ্বাসে তিনি পরবর্তী পংক্তিগুচ্ছ আবৃত্তি শুরু করলেন:

কাফেরের অন্ধকার আসমানে ইসলামের পবিত্র সূর্য
উঠিয়েছে মোহাম্মদ বিন কাশিমের শৌর্য।
কাফেরের নাপাক জমিনে ধ্বনিত হয়েছে পাক আল্লাহ’র নাম
মোহাম্মদ বিন কাশিমের তলোয়ারেই বেঁচে থাকবে ইসলাম।
কাফেরের রক্তে লিখে আল্লাহ্’র নাম
মোহম্মদ বিন কাশিম রেখেছেন নবীজির সম্মান।
বসন্তের কোকিলের কণ্ঠেও আজ যার নাম
সেই মোহাম্মদ বিন কাশিমকে হাজার সালাম।

আবৃত্তি শেষ হলে কবি বিপুল উচ্ছ্বাসে নিজের মুষ্টিবদ্ধ ডানহাত ঊর্ধ্বে ছুড়তে ছুড়তে বললেন, ‘মারহাবা! মারহাবা! কেমন হয়েছে নাসিরউদ্দিন?’

‘মারহাবা, মারহাবা; খুব ভাল, খুব ভাল।’ নাসিরউদ্দিন নামক সুদর্শন কিশোর ক্রীতদাসের চোখ থেকে অশ্রু ঝ’রে পড়ছে, কিন্তু কবি তা দেখতে পাচ্ছেন না!

‘জাঁহাপনার ছন্দ হবে বলছো?’

‘খুব হবে, শিরোপা দেবে আপনাকে।’

‘সোবাহানআল্লাহ সোবাহানআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ; নাসিরউদ্দিন, তাহলে আমিও তোমাকে শিরোপা দেব; এক রাতের জন্য দাসী জোহরাকে তুমি পাবে!’

নাসিরউদ্দিনকে চুপ থাকতে দেখে কবি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আহ্ তোমাকে কতোবার বলেছি যে, কোনো সুংসংবাদ পেলে আলহামদুলিল্লাহ বলতে হয়!’

নাসিরউদ্দিন দ্রুত উচ্চারণ করলো, ‘আলহামদুল্লাহ... আলহামদুল্লাহ...!’

‘আলহামদুল্লাহ নয়, নালায়েক; আলহামদুলিল্লাহ! মালাউন ভারতীয়, আল্লাহ্’র পবিত্র ভাষাও মুখে আনতে পারে না! তিনবার বলো, আলহামদুলিল্লাহ...!’

নাসিরউদ্দিন খুব সাবধানে উচ্চারণ করলো, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।’ 

কবি কয়েক মুহূর্ত নীরবে নিজের লেখায় চোখ বুলালেন, দু'টি সংশোধন করলেন, তারপর পুনরায় কিছু পংক্তি আবৃত্তি করার পর ওপরে দু'হাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শুকরিয়া, শুকরিয়া, আপনার অশেষ মেহেরবানি; আমিন।’

কবির দেখাদেখি পাখা রেখে নাসিরউদ্দিনও দু'হাত ওপরে তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘শুকরিয়া, শুকরিয়া, আপনার অশেষ মেহেরবানি; আমিন।’

নাসিরুদ্দিন পুনরায় পাখা হাতে নিয়ে কবিকে বাতাস করতে লাগলেন। মুখে হাসি ছড়িয়ে কবি নাসিরউদ্দিনের উদ্দেশে বললেন, ‘শিরোপা পাব বলছো, নাসিরউদ্দিন?’

‘আলবত পাবেন, আলবত পাবেন।’

‘কবি মোহাম্মদ আফাজউল্লাহ আর শামসুদ্দিন খাঁর চেয়ে আমি ঢের বড় কবি নই, নাসিরউদ্দিন?’

‘আলবত আপনি তাদের চেয়ে বড় কবি। গেল সপ্তাহের কবিতার আসরেও তো তারা আপনার কাছে হেরে গেল!’

‘নাসিরুদ্দিন...’

‘জী।’

‘কাছে এসো।’

নাসিরউদ্দিন পাখা রেখে ব্যস্ত হাতে চোখের জল মুছে কবির বাম হাতের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, কবি তার ডান হাত ধরে কাছে বসিয়ে বাঁ হাতে তাকে নিজের শরীরের সাথে ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে ধ’রে কপালে চুমু খেলেন, এরপর চুমু খেলেন দুইগালে এবং ঠোঁটে। তার চুল আঘ্রাণ ক’রে বললেন, ‘তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় নোকর, ইহজগতের গেলমান; আমি যদি জাঁহাপনার কাছ থেকে শিরোপা পাই, তাহলে এক রাত নয়, তোমাকে তিন রাতের জন্য দাসী জোহরাকে উপহার দেব; আর অতি উত্তম বাক্য বলার জন্য আজকের রাতটি কোনো বিবি কিংবা দাসী নয়, আমি তোমাকে উপহার দেব, প্রিয় গেলমান আমার!’

পুনরায় নাসিরউদ্দিনের কপালে ও মাথায় চুমু খেয়ে বললেন, ‘যাও, খুশ দিলে আমাকে হাওয়া করো।’ 

নাসিরউদ্দিন আবার পাখার বাতাস করতে লাগলো। আর কবি পুনরায় কবিতা রচনায় মনযোগ দিলেন। কবির কবিতাগুলো না মানবপ্রেমের, না ঈশ্বরপ্রেমের, না প্রকৃতিপ্রেমের; সকলই শাসকপ্রেমের কসিদা। গত বর্ষায় সিন্ধু জয় করা, সদ্য যৌবনে পা দেওয়া শাসক মোহাম্মদ বিন কাশিমের স্তুতিগাথা; অন্যান্য যোদ্ধাদের স্তুতিগাথা। কীভাবে তারা বীরত্ব দেখিয়ে কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, কীভাবে কাফেরদের ধড় থেকে মাথা আলাদা ক’রে ফেলেছে, কীভাবে কাফেরদের মন্দির এবং মূর্তি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে, কীভাবে কাফের রাজা দাহিরের মস্তক ছিন্ন ক’রে মস্তকের সাথে লুণ্ঠিত মূল্যবান সামগ্রী এবং রূপবতী নারী ও ক্রীতদাস উপহারস্বরূপ দামেস্কে পাঠানো হয়েছে খলিফা আল-ওয়ালিদের নিকট ইত্যাদি! দুয়েকটি কবিতা কাফের যুবতীদের আশ্চর্য সৌন্দর্য, তাদের যৌনদাসীতে রূপান্তরিত হওয়া এবং তাদের সঙ্গে রতিসুখ বিষয়ক!

একটু পর এক বালিকা দাসী দু'পাত্র মদ নিয়ে এলো, কবির লেখার জলচৌকির পাশের আরেকটি জলচৌকির ওপর নামিয়ে রাখতেই কবি দুই হাতে তার মুখমণ্ডল ধরে কপালে ও ঠোঁটে চুমু খেয়ে গাল টিপে দিলেন, তারপর তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন, কিন্তু এই আদর দাসীটির মুখের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারলো না, বরং মুখশ্রীতে ভেসে উঠলো গোপন ব্যথার সুক্ষ্ম আস্তরণ। কবির বুকে মাথা রেখেও সে নির্লিপ্ত রইলো। কবি তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘নার্গিস, প্রিয় বাঁদী আমার, তোমাকে কখনও হাসতে দেখি না কেন, তুমি কি এখনো তোমার কাফের আব্বা-আম্মার কথা মনে ক’রে কষ্ট পাও? তাদেরকে ভুলে যাও নার্গিস, তারা অবিশ্বাসী কাফের ছিলেন, তাই তোমার আব্বাকে হত্যা করা হয়েছে আর তোমার আম্মাকে উম্মতের সেবার জন্য কোথাও পাঠানো হয়েছে। তোমার আব্বা এখন দোজখের আগুনে জ্বলছে। তুমি এখন মুসলমান, ন্যায় ও সত্য ধর্মের পথে এসেছো; পুরনো দিনের কথা ভুলে যাও, আর নতুন ক’রে বাঁচো। কাফের আব্বা-আম্মার কথা ভেবে কখনোই মন খারাপ করবে না, চোখের জলও ফেলবে না; তাহলে আল্লাহ্ তোমার ওপর নাখোশ হবেন। খুশ দিলে থাকো আর আমার সেবা করো, প্রিয় বাঁদী।’

নার্গিসের কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘যাও।’ 

চলে গেল নার্গিস। কবি পানপাত্রে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘নাসিরুদ্দিন...।’

‘জ্বী।’

‘নার্গিস এখনো গোলাপের কুড়ি। দু-তিন বছর পর ও বসরাই গোলাপের মতো প্রস্ফুটিত হয়ে রোশনাই ছড়াবে! আল্লাহ্ যেন ততোদিন আমাকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করেন, আমি ওর গর্ভে আমার শ্রেষ্ঠ সন্তান উৎপাদন করতে চাই। আমিন।’

নাসিরউদ্দিনও কবিকে অনুসরণ করলো, ‘আমিন।’

কবি লেখার ফাঁকে ফাঁকে পানপাত্রে চুমুক দিতে লাগলেন। লিখতে লিখতে কখনো বিড়বিড় করলেন, কখনো নিচুস্বরে আবার কখনো গলা ছেড়ে আবৃত্তি করলেন। থেকে থেকে নিজেই প্রশংসা করলেন নিজের কবিতার আবার কখনো নাসিরউদ্দিনের কাছ থেকে প্রশংসা আদায় ক’রে নিলেন। দীর্ঘক্ষণ লেখার পর অন্য একজন দাসী এসে কুর্নিশ ক’রে জানালো, ‘গোসলের পানি প্রস্তুত।’

দাসীর বয়স চৌদ্দ-পনের, গায়ের রঙ প্রায় ফর্সা এবং সুন্দরী। পরনে শাড়ি, শাড়ির ফাঁক দিয়ে তার পেটে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায় যে, সে আড়াই-তিন মাসের পোয়াতি। সদ্য স্নান করায় তাকে যেমনি স্নিগ্ধ লাগছে, তেমনি গা থেকে একটা স্নিগ্ধ গন্ধও ছড়াচ্ছে। সে, মনে হয়, কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে। কবি প্রথমে তার মুখের দিকে তাকালেন, তারপর মাথা থেকে পা অবধি দৃষ্টি বুলিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘জোহরা, আমার একবার কঠিন পীড়া হয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ্ তখন আমাকে বেহেশতে তুলে নেননি কেন, জানো? ভারতীয় মেয়েদের সেবা গ্রহণ করার জন্য, তাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করার জন্য। তোমরা ভারতীয় মেয়েরা অপার সৌন্দর্যের অধিকারী, তোমাদের শরীর আমার কাছে এক মহাবিস্ময়; তোমাদের স্পর্শে দেহাভ্যন্তরে বয়ে যায় সাইমুম! স্নানের পরে তোমাকে অপূর্ব লাগছে জোহরা!’

জোহরা হাত কপালে ছুঁইয়ে বললো, ‘শুকরিয়া।’

কবি কলম রেখে হাত বাড়িয়ে দিলেন জোহরার দিকে। তিনি জোহরার হাতের সাহায্য নিয়ে উঠলেন, জোহরার কপালে চুমু খেয়ে তার চুলে নাক গুঁজে গন্ধ শুঁকে বললেন, ‘আশ্চর্য তোমার শরীরের ঘ্রাণ! চলো, প্রিয় বাঁদী আমার।’

কবি জোহরাকে ডানপাশে রেখে তার পিঠের ওপর দিয়ে হাত নিয়ে পেটের ডানপাশে বীণার তারের মতো আঙুলের স্পন্দন করতে করতে হাঁটতে শুরু করলেন; তারপর হঠাৎ মাথাটা পিছনে ঘুরিয়ে নাসিরউদ্দিনের মুখে দৃষ্টি রেখে বললেন, ‘শিরোপা পেলে আমি আমার কথা রাখবো, নাসিরউদ্দিন!’

তারপর ঘাড় ফিরিয়ে পুনরায় একইভাবে হাঁটতে লাগলেন বাসগৃহের দিকে। নাসিরুদ্দিন পাখা নামিয়ে রেখে কবির লেখার উটের চামড়া এবং কালি-কলম গোছাতে লাগলো। আমি কাঁঠালগাছের শাখা থেকে ভূমিস্পর্শ করা মাত্র মানুষ হলাম, আমাকে দেখে ওর হাত থেমে গেল।

বললাম, ‘তোমার নাম নাসিরউদ্দিন?’

ও নীরবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, বুঝিবা ভয়ে। বললাম, ‘আমাকে ভয় পেয়ো না।’

ঘাড় নেড়ে জানালো, ‘হ্যাঁ।’

‘তোমার বাবার নাম।’

আবারও চুপ ক’রে আমার মুখে দিকে তাকিয়ে রইলো। বললাম, ‘বলো, তোমার বাবার নাম কী?’

ছেলেটার চোখে জলের জোয়ার, হয়তো এখনই ঝ’রে পড়বে। মাটির দিকে মাথা নামিয়ে বললো, ‘চন্দ্রদেব।’

‘আর তোমার আগের নাম?’

‘অর্জুন।’

অর্জুনের চোখ থেকে দু-ফোঁটা জল ঝুপ ক’রে ঝ’রে পড়লো মাটিতে। বললাম, ‘কবিতা শুনে কষ্ট পেয়েছো?’

ঘাড় নেড়ে বললো, ‘হ্যাঁ।’

‘কবিকে খুশি করতে ভাল বলেছ?’

‘হ্যাঁ, নইলে মারতো।’

‘এখানে তোমার আপনজন কেউ নেই?’

‘না, আমার বাবাকে ওরা মেরে ফেলেছে; আমার মামার মাথা কেটে খলিফার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর বুড়ো কবিটা সেইসব কথাই লিখেছে কবিতায়।’

‘মহারাজ দাহির তোমার মামা?’

‘হ্যাঁ, আমার মায়ের মামাতো ভাই। আমাদের পরিবারের সব পুরুষদেরকে মেরে ফেলেছে, মেয়েদের আর ছোটদেরকে দাস-দাসী বানিয়েছে। আমার মা কোথায় আছে আমি জানি না, আমি মনে হয় আর কোনোদিন আমার মাকে দেখতে পাব না।’

বলতে বলতে কেঁদে ফেললো অর্জুন। আমি ওর পিঠে আমার সান্ত্বনার হাত রাখলাম, মুখে বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না। চৌদ্দ-পনের বছরের কিশোর, যার এখন খেলাধূলা করার বয়স, পাঠশালায় লেখাপড়া করার বয়স, সে এখন বাবা-মাকে হারিয়ে এক কবির সেবাদাস-যৌনদাস হয়ে জীবন কাটাচ্ছে; একে সান্ত্বনা দেবার মতো শব্দ বা ভাষার কি জন্ম হয়েছে পৃথিবীতে!

বেশ কিছুক্ষণ পর বললাম, ‘এই বাড়িতে একজন নারী আছেন, বয়স চল্লিশের মতো, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ; সাদা শাড়ি প’রে ঐ পূর্বদিকের জানালায় আমি তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, তুমি চেন তাকে?’

‘চিনি তো, সত্যবতী মাসি।’

‘তিনি এখানে কী করছেন?’

‘তিনিও একজন দাসী।’

‘আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। তুমি এই সংবাদটি তাকে দিতে পারবে?’

‘হ্যাঁ, পারবো।’

‘আমি রাতে তার জন্য এখানে অপেক্ষা করবো, তিনি যেন এখানে আমার সঙ্গে দেখা করেন।’

‘আপনি তার কী হন?’

‘আমি তাঁর আত্মীয়। তুমি খবরটা সাবধানে দিও, কেউ যেন বুঝতে না পারে।’

‘কেউ বুঝতে পারবে না। আমি গোপনে মাসিকে বলবো। আমি এখন যাই, নইলে বুড়ো কবিটা আবার বকবে।’

‘আচ্ছা, যাও।’

‘আপনার বসার জন্য একখানা জলচৌকি রেখে গেলাম।’

‘জলচৌকি নিয়ে না গেলে কেউ কিছু বলবে না?’

‘বললে বলবো ভুলে ফেলে এসেছি। মাসি আপনার কাছে এলেও বসতে পারবে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাসির কষ্ট হয়, আবার মাটিতে বসতেও পারে না।’

শুধু জলচৌকিখানা রেখে অন্য সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল অর্জুন। রাজার ভাগ্নে, সকলের আদরের দুলাল; বাবা-মা হয়তো মহাভারতের অর্জুনের নামে ওর নাম রেখেছিল অর্জুন, হয়তো ভেবেছিল ছেলে বড় হলে অর্জুনের মতোই বীর হবে; অথচ সেই ছেলে আজ একজন কবির ক্রীতদাস; যে কবি কিনা তারই পিতা ও আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করার জন্য শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে লিখছে শাসকের স্তুতিগাথা, প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছে! হায়, কবি এতোটাই বিবেকহীন নির্লজ্জ আর শাসকের পদলেহনকারী জ্ঞানদাস যে, ভুলে গেছে মানবতা; মানবতার পক্ষে না লিখে লিখছে হত্যাকারী, লুণ্ঠনকারী, ধর্ষকের প্রশস্তিগাথা! যে জাতির কবি শাসকের গোলাম; সে জাতি তো উন্মত্ত, উদ্ভ্রান্ত, হিংস্র, লোভী, ধর্ষক, রক্তপিপাসু, পথভ্রষ্ট হবেই! 

এখন অনেক রাত, ঝিঁঝির খেয়াল ব্যতিত চতুর্দিক সুনসান। আমি বাগানে কাঁঠালগাছের নিচে ঘন অন্ধকারে জলচৌকির ওপর বসে আছি সত্যবতী দেবীর অপেক্ষায়, যিনি আমার মায়ের বহু প্রজন্ম আগের পূর্বসূরি, যার সঙ্গে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। কিন্তু তিনি দেরি করছেন কেন, বুঝতে পারছি না। অর্জুন সংবাদটা ঠিক মতো দিতে পেরেছে তো, নাকি সংবাদ পেয়েও আসার সুযোগ পাচ্ছেন না? অন্ধকারে বসে বারবার পথের দিকে তাকাচ্ছি, আমার ভাবনা জুড়ে কেবলই তিনি, দৃষ্টিজুড়ে জানালায় দণ্ডায়মাণ তাঁর ছবি। একসময় গাছের অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এলেন সত্যবতী দেবী, আমি কাঁঠালগাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে অনুজ্জ্বল চাঁদের কৃপণ আলোয় গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি আমার ছোঁয়ার দূরত্বে এসে দাঁড়ালেন। তিনি কেমন আছেন, এই প্রশ্ন করা এখন উপহাসের নামান্তর। তাই একবারেই বললাম, ‘আমি আপনার উত্তরসূরির পুত্র।’

(চলবে)