শনিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৬

সাইমুম (উপন্যাস: পর্ব ১৪)


ব্যথা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমি উড়ছি, অতিক্রম করছি ব্র‏হ্মপুত্র, পদ্মা, ভাগীরথী, গঙ্গা, যমুনা আরও কতো শত নদ-নদী ও জনপদ; উড়ে যাচ্ছি আরো অতীতের দিকে, নিগূঢ় শেকড়ের সন্ধানে। পাহাড়, সমভূমি, মরুভূমির ওপর দিয়ে অনবরত উড়ে চলেছি আমি এক মুক্ত হলদে পাখি, দু'ডানায় ক্লান্তি ভর করলে জিরিয়ে নিচ্ছি কোনো পাহাড়ি ঝিরির পাশের তেঁতুল কি হরিতকী কিংবা নাম-না-জানা কোনো বৃক্ষশাখায় বসে, ঝিরির জল পান ক’রে তৃষ্ণা মিটাচ্ছি; কখনো বা বসছি কোনো নদীর পারের বটবৃক্ষের ডালে, নিচে নেমে ঠোঁট ডুবিয়ে আকন্ঠ পান করছি নদীর জল; রাজস্থানের তপ্ত মরুভূমির কোনো কিনারের পাথর চুইয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা জলে দূর করছি বুকের খরা। তারপর আবার উড়ছি, কেবলই উড়ছি অতীতের দিকে। উড়তে উড়তে সিন্ধু নদী পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ৭১৩ খ্রিষ্টাব্দের বসন্তে সিন্ধু রাজ্যের দেবল বন্দরে। বন্দর সংলগ্ন এলাকায় এক পাক উড়ে এসে বসলাম বন্দরের কাছের এক পুরাতন উঁচু অশ্বত্থের মগডালে, এখনো কোথাও কোথাও রয়েছে ধ্বংসের চি‎‎হ্ন; গত বছর জুন মাসে ব্রাহ্মণ রাজা দাহিরকে পরাজিত ক’রে দেবল নগরী দখল করেছে মোহাম্মদ বিন কাশিম। আমি উড়াল দিলাম নগরীর ভেতরের দিকে; কোথাও ঘরবাড়ির পোড়া কাঠামো, কোথাও বড় বড় প্রসাদ কিংবা মন্দিরের ধ্বংসস্তুপ চোখে পড়লো; কোথাও পুরাতন প্রাসাদের জায়গায় তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন ইমারত, মন্দিরের জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে মসজিদ এবং উঁচু মিনার। আমি একটি পিপুলগাছে বসে দেখলাম, এক জায়গায় বিশাল একটি মন্দির ধ্বংস করার পর সেই মন্দিরের পাথর এবং অন্যান্য মাল-মসলা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিশাল মসজিদ। ভারতীয় নব্য মুসলমান ক্রীতদাস কারিগররা ত্রস্ত হয়ে ব্যস্ত হাতে মসজিদ নির্মাণের কাজ করছে; নিকট অতীতে এদের কাউকে অজিত থেকে আজিজ, কাউকে নকুল থেকে কবিরুল করা হয়েছে। আজিজ-কবিরুলদের বিশ্রামের কোনো সুযোগ নেই, যেন বা নেই ক্ষুধা-তৃষ্ণাও! কেবল কাজ করার জন্যই তাদের জন্ম হয়েছে, এক মনে তারা কাজ করছে। অপেক্ষাকৃত উচ্চ মর্যাদার আরব ক্রীতদাসরা চাবুক হাতে তাদের ওপর নরজদারি করছে। তারপরও সামান্য কোনো ভুল-ত্রুটি হলেই আরব ক্রীতদাসদের চাবুক আছড়ে পড়ছে তাদের পিঠে, তাদের মাথা ঠুকে দিচ্ছে দেয়ালে। মাটিতে ফেলে কাউকে কাউকে পা দিয়ে পিষছে তাদের কওমের ভাইয়েরা!

আমি নগরীর রাস্তায় নেমে নব্য মুসলমানের বেশে গায়ে আলখাল্লা-মাথায় পাগড়ি প’রে হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমার সামনে পড়লো একটি ক্রীতদাসের বহর; আমি পথ ছেড়ে দাঁড়ালাম একটা গাছের আড়ালে। চামড়ার ফিতা দিয়ে ক্রীতদাসদের হাত পিছমোড়া ক’রে বাঁধা, আবার কারো কারো হাতে-পায়ে লোহার বেড়ি ও শেকল পরানো! তাদের মধ্যে নারী এবং পুরুষ উভয়ই আছে, আছে অল্পবয়সী বালক-বালিকা ও শিশু। শরীরে জীর্ণ-শীর্ণ পোশাক; শরীরের অনাবৃত অংশে চাবুকের লালচে লম্বা দাগ। সকলেই ক্লান্ত, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর; অপেক্ষাকৃত দুর্বলরা খুব কষ্টে দলের অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটছে চাবুকের ঘা খেতে খেতে, অশ্রুশূন্য শুষ্ক তাদের চোখ, গালে ময়লা কাটা শুকনো অশ্রুরেখা। চাবুক হাতে তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে কয়েকজন অশ্বারোহী আরব মুসলমান; তাদের কথায় কান পেতে বুঝলাম, যাত্রাপথে এই বহরটির সাথে আরো কয়েকটি বহর যোগ হবে। তারপর একত্রিত বিশাল বহরটিকে নিয়ে যাওয়া হবে প্রথমে বাগদাদে, কিছু বিক্রি করা হবে বাগদাদের দাসবাজারে; অবশিষ্ট দাসদের পাঠানো হবে দামেস্কে।

টানা দু'দিন আমি কখনো মুসলমানের বেশে কখনো বা হলদে পাখি হয়ে দেবল নগরীতে ঘুরে বেড়ালাম আর প্রত্যক্ষ করলাম মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট। সর্বত্রই প্রায় একই রকম দৃশ্য; কোথাও ক্রীতদাসরা ধাতু কারখানায় অস্ত্র এবং বর্ম তৈরি করছে, কোথাও তৈরি করছে সোনা-রূপা-তামার অলঙ্কার, কোথাও মাঠ থেকে ফসল কেটে এনে প্রক্রিয়াজাত করছে, কোথাও বস্ত্র কিংবা নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি তৈরি করছে, কোথাও খনন করছে কিংবা ভারী বস্তু বহন করছে; আর সবখানেই তাদের ওপর নজরদারি ও নিপীড়ন করছে আরবরা। সর্বত্রই একই রকম নিপীড়ন ক্রীতদাসদের ওপর। কোথাও কোথাও নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে মানসিকভাবে দুর্বল কোনো ক্রীতদাস আত্মহত্যাও করছে। এই জনপদে মানুষের দুঃখগাথা ব্যতিত যেন কিছু নেই! ভারতীয়দের মুখে কোনো হাসি নেই, জীবনে কোনো সুখ-আনন্দ নেই; নিজের জীবনটাও তাদের নিজের নেই। সকলেই যেন অপরের জীবনের বোঝা বয়ে চলেছে, আপন দেহের ভেতরে আপনিই নেই! 

উড়তে উড়তে আমি এক সাধারণ যোদ্ধার অন্দরমহলের বারান্দার রেলিংয়ের ওপর গিয়ে বসলাম। যোদ্ধা বাড়িতে নেই; আছে দামী রত্ন ও স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিত তার চারজন পত্নী সাধারণ বেশভূষায় ছয়জন ভারতীয় ধর্মান্তরিত যৌনদাসী, তিনজন সুদর্শন বালক ক্রীতদাস আর একজন বালকের মতো দেখতে কিন্তু তার সাজগোজ অনেকটা নারীদের মতোই। বাড়িতে বিপুল বিত্ত-বৈভব। বাড়ির বাইরের মহলে পাহাড়ায় রয়েছে বল্লম হাতে তিনজন ক্রীতদাস। একজন সাধারণ যোদ্ধার এতো দাস-দাসী, বিত্ত-বৈভব; তাহলে আরো বড় যোদ্ধাদের না জানি কী অবস্থা! আমি একজন বড় মাপের ঘোরসওয়ার যোদ্ধার বাড়ির আমগাছে গিয়ে বসলাম। আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল দেখে; দামী আসবাপত্র, বাসন-কোসন, পত্নী, দাস-দাসীর যেন অভাব নেই! এরপর আমি সেনাপতির বিশাল প্রাসাদের এদিক-সেদিক উঁকি দিলাম; অসংখ্য পত্নী, যৌনদাসী আর দাস-দাসীর বহর দেখে আমার বেঁহুশ অবস্থা! এলোমেলোভাবে উড়তে লাগলাম যোদ্ধা আর পদস্থ আরবীয়দের বাড়ির ওপর দিয়ে। একটা ব্যাপার আমাকে বিস্মিত করলো, ঋতুবতী নারী মাত্রই গর্ভবতী; তা সে বয়স বারো হোক কিংবা বায়ান্ন, পত্নী কিংবা দাসী! একসঙ্গে এতো নারী গর্ভবতী হবার কী রহস্য! পত্নীরা অন্দরমহলে উঁচু পেট নিয়ে হাঁটছে, খাচ্ছে, দাস-দাসীদের সেবা গ্রহণ করছে; দাসীরা উঁচু পেট নিয়ে মালকিনের সেবা এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম করছে!

উড়ে যাবার সময় একটা বাড়ির জানালায় চোখ পড়তেই আমি ফিরে এসে বসলাম জানালা থেকে সামান্য দূরত্বের একটা পেয়ারা গাছের ডালে, ঘরের ভেতর জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে নীরবে চোখের জল ফেলছেন খোলা চুলের বছর চল্লিশের এক নারী; পরনে সাদা শাড়ি, গায়ে কিছু নেই। বুকে শাড়ির আগল থাকলেও অনাবৃত তার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ চিকন বাহু আর স্ফীত পেট, যথারীতি তিনিও গর্ভবতী! আমি তাঁর চোখ চিনি, চিনি তার চোয়াল আর চুল; তিনি আমার মায়ের পূর্বসুরি! তার সঙ্গে কথা বলার উদগ্র বাসনায় আমি পেয়ারা গাছ থেকে ভূমিতে নামতে যাব এমন সময় আমাকে হতাশ ক’রে এক যুবতী এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেল অন্য কক্ষে। আমি এদিকে-ওদিকে উঁকি দিয়েও তাকে আর দেখতে পেলাম না। কিন্তু দেখা যে আমাকে করতেই হবে, আবার কখন তাকে একা পাব, সেই অপেক্ষায় এগাছ-ওগাছ করছি। এমন সময় চোখ পড়লো এই বাড়িরই পিছন দিকের বাগানে, একজন প্রৌঢ় শীতলপাটিতে বসে সামনের জলচৌকির ওপর ঝুঁকে কিছু লিখছেন আর বারবার কালির পাত্রে কলম চুবিয়ে নিচ্ছেন। পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে পাখার বাতাস করছে এক সুদর্শন কিশোর, আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, কিশোরটি প্রৌঢ়ের ক্রীতদাস। আমি উড়ে গিয়ে বসলাম তাদের মাথার ওপরের কাঁঠাল গাছের ডালে। প্রৌঢ় একটু পরপর কালির পাত্রে কলম চুবিয়ে উটের চামড়ায় একমনে লিখছেন। এখন বসন্তকালের শুরু, এলোমেলো বাতাস বইছে, তেমন গরম লাগছে না, তবু কিশোর অনবরত তার মনিবকে বাতাস ক’রে চলেছে। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি প্রৌঢ়কে; দুধে আলতা তার গায়ের রঙ, দাড়ি-গোঁফের আশি ভাগই সাদা, মাথায় সাদা পাগড়ি, গায়ে সাদা আলখাল্লা। কিছুক্ষণ পর বেশ তৃপ্তির সঙ্গে কলমটি রেখে আবৃত্তি করতে লাগলেন নিজের ছন্দবদ্ধ লেখাগুলো। বুঝলাম যে, তিনি একজন কবি। পর পর কিছু পংক্তি আবৃত্তি করার পর তার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, দারুণ উদ্যম আর উচ্ছ্বাসে তিনি পরবর্তী পংক্তিগুচ্ছ আবৃত্তি শুরু করলেন:

কাফেরের অন্ধকার আসমানে ইসলামের পবিত্র সূর্য
উঠিয়েছে মোহাম্মদ বিন কাশিমের শৌর্য।
কাফেরের নাপাক জমিনে ধ্বনিত হয়েছে পাক আল্লাহ’র নাম
মোহাম্মদ বিন কাশিমের তলোয়ারেই বেঁচে থাকবে ইসলাম।
কাফেরের রক্তে লিখে আল্লাহ্’র নাম
মোহম্মদ বিন কাশিম রেখেছেন নবীজির সম্মান।
বসন্তের কোকিলের কণ্ঠেও আজ যার নাম
সেই মোহাম্মদ বিন কাশিমকে হাজার সালাম।

আবৃত্তি শেষ হলে কবি বিপুল উচ্ছ্বাসে নিজের মুষ্টিবদ্ধ ডানহাত ঊর্ধ্বে ছুড়তে ছুড়তে বললেন, ‘মারহাবা! মারহাবা! কেমন হয়েছে নাসিরউদ্দিন?’

‘মারহাবা, মারহাবা; খুব ভাল, খুব ভাল।’ নাসিরউদ্দিন নামক সুদর্শন কিশোর ক্রীতদাসের চোখ থেকে অশ্রু ঝ’রে পড়ছে, কিন্তু কবি তা দেখতে পাচ্ছেন না!

‘জাঁহাপনার ছন্দ হবে বলছো?’

‘খুব হবে, শিরোপা দেবে আপনাকে।’

‘সোবাহানআল্লাহ সোবাহানআল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ; নাসিরউদ্দিন, তাহলে আমিও তোমাকে শিরোপা দেব; এক রাতের জন্য দাসী জোহরাকে তুমি পাবে!’

নাসিরউদ্দিনকে চুপ থাকতে দেখে কবি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আহ্ তোমাকে কতোবার বলেছি যে, কোনো সুংসংবাদ পেলে আলহামদুলিল্লাহ বলতে হয়!’

নাসিরউদ্দিন দ্রুত উচ্চারণ করলো, ‘আলহামদুল্লাহ... আলহামদুল্লাহ...!’

‘আলহামদুল্লাহ নয়, নালায়েক; আলহামদুলিল্লাহ! মালাউন ভারতীয়, আল্লাহ্’র পবিত্র ভাষাও মুখে আনতে পারে না! তিনবার বলো, আলহামদুলিল্লাহ...!’

নাসিরউদ্দিন খুব সাবধানে উচ্চারণ করলো, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।’ 

কবি কয়েক মুহূর্ত নীরবে নিজের লেখায় চোখ বুলালেন, দু'টি সংশোধন করলেন, তারপর পুনরায় কিছু পংক্তি আবৃত্তি করার পর ওপরে দু'হাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শুকরিয়া, শুকরিয়া, আপনার অশেষ মেহেরবানি; আমিন।’

কবির দেখাদেখি পাখা রেখে নাসিরউদ্দিনও দু'হাত ওপরে তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘শুকরিয়া, শুকরিয়া, আপনার অশেষ মেহেরবানি; আমিন।’

নাসিরুদ্দিন পুনরায় পাখা হাতে নিয়ে কবিকে বাতাস করতে লাগলেন। মুখে হাসি ছড়িয়ে কবি নাসিরউদ্দিনের উদ্দেশে বললেন, ‘শিরোপা পাব বলছো, নাসিরউদ্দিন?’

‘আলবত পাবেন, আলবত পাবেন।’

‘কবি মোহাম্মদ আফাজউল্লাহ আর শামসুদ্দিন খাঁর চেয়ে আমি ঢের বড় কবি নই, নাসিরউদ্দিন?’

‘আলবত আপনি তাদের চেয়ে বড় কবি। গেল সপ্তাহের কবিতার আসরেও তো তারা আপনার কাছে হেরে গেল!’

‘নাসিরুদ্দিন...’

‘জী।’

‘কাছে এসো।’

নাসিরউদ্দিন পাখা রেখে ব্যস্ত হাতে চোখের জল মুছে কবির বাম হাতের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, কবি তার ডান হাত ধরে কাছে বসিয়ে বাঁ হাতে তাকে নিজের শরীরের সাথে ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে ধ’রে কপালে চুমু খেলেন, এরপর চুমু খেলেন দুইগালে এবং ঠোঁটে। তার চুল আঘ্রাণ ক’রে বললেন, ‘তুমি আমার সবচেয়ে প্রিয় নোকর, ইহজগতের গেলমান; আমি যদি জাঁহাপনার কাছ থেকে শিরোপা পাই, তাহলে এক রাত নয়, তোমাকে তিন রাতের জন্য দাসী জোহরাকে উপহার দেব; আর অতি উত্তম বাক্য বলার জন্য আজকের রাতটি কোনো বিবি কিংবা দাসী নয়, আমি তোমাকে উপহার দেব, প্রিয় গেলমান আমার!’

পুনরায় নাসিরউদ্দিনের কপালে ও মাথায় চুমু খেয়ে বললেন, ‘যাও, খুশ দিলে আমাকে হাওয়া করো।’ 

নাসিরউদ্দিন আবার পাখার বাতাস করতে লাগলো। আর কবি পুনরায় কবিতা রচনায় মনযোগ দিলেন। কবির কবিতাগুলো না মানবপ্রেমের, না ঈশ্বরপ্রেমের, না প্রকৃতিপ্রেমের; সকলই শাসকপ্রেমের কসিদা। গত বর্ষায় সিন্ধু জয় করা, সদ্য যৌবনে পা দেওয়া শাসক মোহাম্মদ বিন কাশিমের স্তুতিগাথা; অন্যান্য যোদ্ধাদের স্তুতিগাথা। কীভাবে তারা বীরত্ব দেখিয়ে কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, কীভাবে কাফেরদের ধড় থেকে মাথা আলাদা ক’রে ফেলেছে, কীভাবে কাফেরদের মন্দির এবং মূর্তি ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে, কীভাবে কাফের রাজা দাহিরের মস্তক ছিন্ন ক’রে মস্তকের সাথে লুণ্ঠিত মূল্যবান সামগ্রী এবং রূপবতী নারী ও ক্রীতদাস উপহারস্বরূপ দামেস্কে পাঠানো হয়েছে খলিফা আল-ওয়ালিদের নিকট ইত্যাদি! দুয়েকটি কবিতা কাফের যুবতীদের আশ্চর্য সৌন্দর্য, তাদের যৌনদাসীতে রূপান্তরিত হওয়া এবং তাদের সঙ্গে রতিসুখ বিষয়ক!

একটু পর এক বালিকা দাসী দু'পাত্র মদ নিয়ে এলো, কবির লেখার জলচৌকির পাশের আরেকটি জলচৌকির ওপর নামিয়ে রাখতেই কবি দুই হাতে তার মুখমণ্ডল ধরে কপালে ও ঠোঁটে চুমু খেয়ে গাল টিপে দিলেন, তারপর তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন, কিন্তু এই আদর দাসীটির মুখের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারলো না, বরং মুখশ্রীতে ভেসে উঠলো গোপন ব্যথার সুক্ষ্ম আস্তরণ। কবির বুকে মাথা রেখেও সে নির্লিপ্ত রইলো। কবি তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ‘নার্গিস, প্রিয় বাঁদী আমার, তোমাকে কখনও হাসতে দেখি না কেন, তুমি কি এখনো তোমার কাফের আব্বা-আম্মার কথা মনে ক’রে কষ্ট পাও? তাদেরকে ভুলে যাও নার্গিস, তারা অবিশ্বাসী কাফের ছিলেন, তাই তোমার আব্বাকে হত্যা করা হয়েছে আর তোমার আম্মাকে উম্মতের সেবার জন্য কোথাও পাঠানো হয়েছে। তোমার আব্বা এখন দোজখের আগুনে জ্বলছে। তুমি এখন মুসলমান, ন্যায় ও সত্য ধর্মের পথে এসেছো; পুরনো দিনের কথা ভুলে যাও, আর নতুন ক’রে বাঁচো। কাফের আব্বা-আম্মার কথা ভেবে কখনোই মন খারাপ করবে না, চোখের জলও ফেলবে না; তাহলে আল্লাহ্ তোমার ওপর নাখোশ হবেন। খুশ দিলে থাকো আর আমার সেবা করো, প্রিয় বাঁদী।’

নার্গিসের কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘যাও।’ 

চলে গেল নার্গিস। কবি পানপাত্রে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘নাসিরুদ্দিন...।’

‘জ্বী।’

‘নার্গিস এখনো গোলাপের কুড়ি। দু-তিন বছর পর ও বসরাই গোলাপের মতো প্রস্ফুটিত হয়ে রোশনাই ছড়াবে! আল্লাহ্ যেন ততোদিন আমাকে বেঁচে থাকার তৌফিক দান করেন, আমি ওর গর্ভে আমার শ্রেষ্ঠ সন্তান উৎপাদন করতে চাই। আমিন।’

নাসিরউদ্দিনও কবিকে অনুসরণ করলো, ‘আমিন।’

কবি লেখার ফাঁকে ফাঁকে পানপাত্রে চুমুক দিতে লাগলেন। লিখতে লিখতে কখনো বিড়বিড় করলেন, কখনো নিচুস্বরে আবার কখনো গলা ছেড়ে আবৃত্তি করলেন। থেকে থেকে নিজেই প্রশংসা করলেন নিজের কবিতার আবার কখনো নাসিরউদ্দিনের কাছ থেকে প্রশংসা আদায় ক’রে নিলেন। দীর্ঘক্ষণ লেখার পর অন্য একজন দাসী এসে কুর্নিশ ক’রে জানালো, ‘গোসলের পানি প্রস্তুত।’

দাসীর বয়স চৌদ্দ-পনের, গায়ের রঙ প্রায় ফর্সা এবং সুন্দরী। পরনে শাড়ি, শাড়ির ফাঁক দিয়ে তার পেটে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায় যে, সে আড়াই-তিন মাসের পোয়াতি। সদ্য স্নান করায় তাকে যেমনি স্নিগ্ধ লাগছে, তেমনি গা থেকে একটা স্নিগ্ধ গন্ধও ছড়াচ্ছে। সে, মনে হয়, কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে। কবি প্রথমে তার মুখের দিকে তাকালেন, তারপর মাথা থেকে পা অবধি দৃষ্টি বুলিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘জোহরা, আমার একবার কঠিন পীড়া হয়েছিল, কিন্তু আল্লাহ্ তখন আমাকে বেহেশতে তুলে নেননি কেন, জানো? ভারতীয় মেয়েদের সেবা গ্রহণ করার জন্য, তাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করার জন্য। তোমরা ভারতীয় মেয়েরা অপার সৌন্দর্যের অধিকারী, তোমাদের শরীর আমার কাছে এক মহাবিস্ময়; তোমাদের স্পর্শে দেহাভ্যন্তরে বয়ে যায় সাইমুম! স্নানের পরে তোমাকে অপূর্ব লাগছে জোহরা!’

জোহরা হাত কপালে ছুঁইয়ে বললো, ‘শুকরিয়া।’

কবি কলম রেখে হাত বাড়িয়ে দিলেন জোহরার দিকে। তিনি জোহরার হাতের সাহায্য নিয়ে উঠলেন, জোহরার কপালে চুমু খেয়ে তার চুলে নাক গুঁজে গন্ধ শুঁকে বললেন, ‘আশ্চর্য তোমার শরীরের ঘ্রাণ! চলো, প্রিয় বাঁদী আমার।’

কবি জোহরাকে ডানপাশে রেখে তার পিঠের ওপর দিয়ে হাত নিয়ে পেটের ডানপাশে বীণার তারের মতো আঙুলের স্পন্দন করতে করতে হাঁটতে শুরু করলেন; তারপর হঠাৎ মাথাটা পিছনে ঘুরিয়ে নাসিরউদ্দিনের মুখে দৃষ্টি রেখে বললেন, ‘শিরোপা পেলে আমি আমার কথা রাখবো, নাসিরউদ্দিন!’

তারপর ঘাড় ফিরিয়ে পুনরায় একইভাবে হাঁটতে লাগলেন বাসগৃহের দিকে। নাসিরুদ্দিন পাখা নামিয়ে রেখে কবির লেখার উটের চামড়া এবং কালি-কলম গোছাতে লাগলো। আমি কাঁঠালগাছের শাখা থেকে ভূমিস্পর্শ করা মাত্র মানুষ হলাম, আমাকে দেখে ওর হাত থেমে গেল।

বললাম, ‘তোমার নাম নাসিরউদ্দিন?’

ও নীরবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, বুঝিবা ভয়ে। বললাম, ‘আমাকে ভয় পেয়ো না।’

ঘাড় নেড়ে জানালো, ‘হ্যাঁ।’

‘তোমার বাবার নাম।’

আবারও চুপ ক’রে আমার মুখে দিকে তাকিয়ে রইলো। বললাম, ‘বলো, তোমার বাবার নাম কী?’

ছেলেটার চোখে জলের জোয়ার, হয়তো এখনই ঝ’রে পড়বে। মাটির দিকে মাথা নামিয়ে বললো, ‘চন্দ্রদেব।’

‘আর তোমার আগের নাম?’

‘অর্জুন।’

অর্জুনের চোখ থেকে দু-ফোঁটা জল ঝুপ ক’রে ঝ’রে পড়লো মাটিতে। বললাম, ‘কবিতা শুনে কষ্ট পেয়েছো?’

ঘাড় নেড়ে বললো, ‘হ্যাঁ।’

‘কবিকে খুশি করতে ভাল বলেছ?’

‘হ্যাঁ, নইলে মারতো।’

‘এখানে তোমার আপনজন কেউ নেই?’

‘না, আমার বাবাকে ওরা মেরে ফেলেছে; আমার মামার মাথা কেটে খলিফার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর বুড়ো কবিটা সেইসব কথাই লিখেছে কবিতায়।’

‘মহারাজ দাহির তোমার মামা?’

‘হ্যাঁ, আমার মায়ের মামাতো ভাই। আমাদের পরিবারের সব পুরুষদেরকে মেরে ফেলেছে, মেয়েদের আর ছোটদেরকে দাস-দাসী বানিয়েছে। আমার মা কোথায় আছে আমি জানি না, আমি মনে হয় আর কোনোদিন আমার মাকে দেখতে পাব না।’

বলতে বলতে কেঁদে ফেললো অর্জুন। আমি ওর পিঠে আমার সান্ত্বনার হাত রাখলাম, মুখে বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না। চৌদ্দ-পনের বছরের কিশোর, যার এখন খেলাধূলা করার বয়স, পাঠশালায় লেখাপড়া করার বয়স, সে এখন বাবা-মাকে হারিয়ে এক কবির সেবাদাস-যৌনদাস হয়ে জীবন কাটাচ্ছে; একে সান্ত্বনা দেবার মতো শব্দ বা ভাষার কি জন্ম হয়েছে পৃথিবীতে!

বেশ কিছুক্ষণ পর বললাম, ‘এই বাড়িতে একজন নারী আছেন, বয়স চল্লিশের মতো, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ; সাদা শাড়ি প’রে ঐ পূর্বদিকের জানালায় আমি তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, তুমি চেন তাকে?’

‘চিনি তো, সত্যবতী মাসি।’

‘তিনি এখানে কী করছেন?’

‘তিনিও একজন দাসী।’

‘আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। তুমি এই সংবাদটি তাকে দিতে পারবে?’

‘হ্যাঁ, পারবো।’

‘আমি রাতে তার জন্য এখানে অপেক্ষা করবো, তিনি যেন এখানে আমার সঙ্গে দেখা করেন।’

‘আপনি তার কী হন?’

‘আমি তাঁর আত্মীয়। তুমি খবরটা সাবধানে দিও, কেউ যেন বুঝতে না পারে।’

‘কেউ বুঝতে পারবে না। আমি গোপনে মাসিকে বলবো। আমি এখন যাই, নইলে বুড়ো কবিটা আবার বকবে।’

‘আচ্ছা, যাও।’

‘আপনার বসার জন্য একখানা জলচৌকি রেখে গেলাম।’

‘জলচৌকি নিয়ে না গেলে কেউ কিছু বলবে না?’

‘বললে বলবো ভুলে ফেলে এসেছি। মাসি আপনার কাছে এলেও বসতে পারবে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাসির কষ্ট হয়, আবার মাটিতে বসতেও পারে না।’

শুধু জলচৌকিখানা রেখে অন্য সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল অর্জুন। রাজার ভাগ্নে, সকলের আদরের দুলাল; বাবা-মা হয়তো মহাভারতের অর্জুনের নামে ওর নাম রেখেছিল অর্জুন, হয়তো ভেবেছিল ছেলে বড় হলে অর্জুনের মতোই বীর হবে; অথচ সেই ছেলে আজ একজন কবির ক্রীতদাস; যে কবি কিনা তারই পিতা ও আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করার জন্য শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে লিখছে শাসকের স্তুতিগাথা, প্রশংসায় ভাসিয়ে দিচ্ছে! হায়, কবি এতোটাই বিবেকহীন নির্লজ্জ আর শাসকের পদলেহনকারী জ্ঞানদাস যে, ভুলে গেছে মানবতা; মানবতার পক্ষে না লিখে লিখছে হত্যাকারী, লুণ্ঠনকারী, ধর্ষকের প্রশস্তিগাথা! যে জাতির কবি শাসকের গোলাম; সে জাতি তো উন্মত্ত, উদ্ভ্রান্ত, হিংস্র, লোভী, ধর্ষক, রক্তপিপাসু, পথভ্রষ্ট হবেই! 

এখন অনেক রাত, ঝিঁঝির খেয়াল ব্যতিত চতুর্দিক সুনসান। আমি বাগানে কাঁঠালগাছের নিচে ঘন অন্ধকারে জলচৌকির ওপর বসে আছি সত্যবতী দেবীর অপেক্ষায়, যিনি আমার মায়ের বহু প্রজন্ম আগের পূর্বসূরি, যার সঙ্গে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। কিন্তু তিনি দেরি করছেন কেন, বুঝতে পারছি না। অর্জুন সংবাদটা ঠিক মতো দিতে পেরেছে তো, নাকি সংবাদ পেয়েও আসার সুযোগ পাচ্ছেন না? অন্ধকারে বসে বারবার পথের দিকে তাকাচ্ছি, আমার ভাবনা জুড়ে কেবলই তিনি, দৃষ্টিজুড়ে জানালায় দণ্ডায়মাণ তাঁর ছবি। একসময় গাছের অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এলেন সত্যবতী দেবী, আমি কাঁঠালগাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে অনুজ্জ্বল চাঁদের কৃপণ আলোয় গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি আমার ছোঁয়ার দূরত্বে এসে দাঁড়ালেন। তিনি কেমন আছেন, এই প্রশ্ন করা এখন উপহাসের নামান্তর। তাই একবারেই বললাম, ‘আমি আপনার উত্তরসূরির পুত্র।’

(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন