লিখেছেন গোলাপ
"যে মুহাম্মদ (সাঃ) কে জানে সে ইসলাম জানে, যে তাঁকে জানে না সে ইসলাম জানে না।"
অতর্কিত আগ্রাসী নৃশংস আক্রমণে খায়বারের নিরীহ জনপদবাসীদের খুন, জখম, বন্দী ও দাস-দাসীকরণের মাধ্যমে তাঁদেরকে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত ও তাঁদের স্থাবর ও অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি দখল করার পর যখন স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন আত্মবিশ্বাসী, তখন তাঁকে কীভাবে বিষ প্রয়োগে হত্যা-চেষ্টা করা হয়েছিলো; কে সেই অসীম সাহসী ব্যক্তি, যে এই কাজটি করেছিলেন; কী কারণে তিনি তা করেছিলেন; সেই বিষের জ্বালায় মুহাম্মদ কী রূপে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুবরণ করেছিলেন - ইত্যাদি বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা আগের পর্বে করা হয়েছে।
অতঃপর লুটের মাল ভাগাভাগি!
মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা এই হামলায় এতো বেশি 'গনিমতের মাল'-এর অধিকারী হয়েছিলেন যে, এই উপার্জনের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের জীবিকার এক স্থায়ী ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। তাঁরা তা কীভাবে সম্পন্ন করেছিলেন, আদি ও বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকদের প্রাণবন্ত বর্ণনার আলোকে সে বিষয়ের ধারাবাহিক আলোচনা পরবর্তী কয়েকটি পর্বে করা হবে।
আল-ওয়াকিদির (৭৪৮-৮২২ খ্রিষ্টাব্দ) অব্যাহত বিস্তারিত বর্ণনা: [1]
পূর্ব প্রকাশিতের (পর্ব-১৪৫) পর:(আবু আল-কেইন আল-মুযাননির কন্যা হইতে > আবু হারমালার বোন উম্মে আবদুল্লাহ হইতে > আবু হারমালা হইতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ইবনে আবি সাবরা আমাকে বলেছেন [পর্ব- ১৪৩]---)
'--- তারা যা বলেছেন: মুসলমানরা যা কিছু লুণ্ঠন করেছিলেন, তার সমস্তরই এক-পঞ্চমাংশ ছিল আল্লাহর নবীর জন্য, তা আল্লাহর নবী সেখানে অংশগ্রহণ করুক কিংবা না করুক। কিন্তু অন্যান্য লোকেরা, যারা তাতে অংশ গ্রহণ করেননি, তাদের জন্য লুণ্ঠিত সম্পদের কোনো হিস্যা ছিল না; এর ব্যতিক্রম হলো বদর যুদ্ধ [পর্ব: ৩০-৪৩], যেখানে তিনি আটজন লোককে হিস্যা প্রদান করেছিলেন, যদিও তারা সেখানে অংশগ্রহণ করেননি, তাতে তাদের প্রত্যেকেরই ছিল অধিকার। তেমনই খায়বার অভিযান ছিল হুদাইবিয়া অংশগ্রহণকারী লোকদের জন্য [পর্ব: ১১১-১২৯], তা তারা সেখানে অংশগ্রহণ করুক কিংবা না করুক।
"আল্লাহ তোমাদেরকে বিপুল পরিমাণ যুদ্ধ-লব্ধ সম্পদের ওয়াদা দিয়েছেন, যা তোমরা লাভ করবে। তিনি তা তোমাদের জন্যে ত্বরান্বিত করবেন (৪৮:২০)"- যা বলা হয়েছে খায়বার অভিযান প্রসঙ্গে [পর্ব- ১২৩]।
যে সমস্ত লোকেরা খায়বার অভিযানে অংশগ্রহণ করেননি, তাঁরা হলেন:
[১] মুরায়া বিন সিনান,
[২] আইমান বিন উবায়েদ ও
[৩] সিবা বিন উরফুতা আল-গিফারি।
[৪] জাবির বিন আবদুল্লাহ ও অন্যান্যদের তিনি তাঁর স্থানে মদিনায় নিযুক্ত করেন।
তাদের মধ্যে দু'জনের মৃত্যু হয়। যারা অনুপস্থিত ছিলেন ও যারা মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তাদেরকে আল্লাহর নবী হিস্যা প্রদান করেন। যে সমস্ত লোকেরা খায়বার অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু আল-হুদাইবিয়া যাত্রায় অংশগ্রহণ করেননি, তাদেরকে তিনি হিস্যা প্রদান করেছিলেন। তিনি হিস্যা প্রদান করেছিলেন তাদেরকে, যাদের তিনি ‘ফাদাক’-এর লোকদের সাথে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন, মুহায়েইসা বিন মাসুদ আল-হারিথি ও অন্যান্যরা।
যারা অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন, আল্লাহর নবী তাদেরকে হিস্যা প্রদান করেছিলেন; এ ছাড়াও আরও তিন অসুস্থ ব্যক্তিকে, যারা এই অভিযানে অংশগ্রহণ করেননি: সুয়ায়েদ বিন আল-নুমান, আবদুল্লাহ বিন সা'দ বিন খেইথামা ও বানু-খুতামা গোত্রের এক ব্যক্তিকে। আর তিনি হিস্যা প্রদান করেছিলেন ঐ সব মৃত ব্যক্তিদের, যারা মুসলমানদের মধ্যে নিহত হয়েছিলেন।
আবদ আল-রাহমান বিন আবদুল্লাহ বিন আবদ আল-রাহমান বিন আবি সা'সায়া হইতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ইবনে আবি সাবরা আমাকে বলেছেন যে এক ভাষ্যকার বলেছেন: বাস্তবিকই খায়বার অভিযানটি ছিল হুদাইবিয়া অংশগ্রহণকারী লোকদের জন্য।তারা ছাড়া অন্য কেউ সেখানে অংশগ্রহণ করেননি, তারা ছাড়া অন্য কাউকে সেখানকার হিস্যা প্রদান করা হয়নি। এর প্রথম উক্তিটি আমাদের সাথে নিশ্চিত করা হয়েছে, যা হলো, যে সমস্ত লোকেরা খায়বার অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল, তারা হুদাইবিয়া যাত্রায় অংশগ্রহণ না করলেও তাদেরকে হিস্যা প্রদান করা হয়েছিলো।'
মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের (৭০৪-৭৬৮ সাল) বর্ণনা: [2] [3]
‘খায়বারের লুণ্ঠন সামগ্রী যখন ভাগাভাগি করে নেয়া হয়; মুসলমানদের ভাগে পড়ে আল-শিইখ ও আল-নাটার সম্পদ, আর আল-কাতিবার সম্পদগুলো পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়:
[১] আল্লাহর অংশ;
[২] নবীর অংশ (তাবারী: 'এক পঞ্চমাংশ')
[৩] স্বজাতি, অনাথ, দরিদ্রদের (তাবারী: 'ও মুসাফিরদের’) অংশ
[৪] নবীর পত্নীদের ভরণপোষণ; এবং
[৫] ‘ফাদাক’ এর লোকদের সাথে শান্তি আলোচনায় [**] মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিযুক্ত লোকদের রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ অংশ। আল্লাহর নবী মুহায়েইসিয়া নামের এক ব্যক্তিকে, যিনি ছিলেন ঐ লোকদের একজন, ৩০ মাল-বোঝাই করা (Load) বার্লি ও ৩০ মাল-বোঝাই করা খেজুর দিয়েছিলেন।
খায়বারে সম্পদগুলো হুদায়বিয়ায় অংশগ্রহণকারী লোকদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেয়া হয়, তা তারা এই অভিযানে অংশ গ্রহণ করুক কিংবা না করুক। একমাত্র যাবির বিন আবদুল্লাহ বিন আমর বিন হারাম ছিলেন অনুপস্থিত, আল্লাহর নাবী তাকে সেই একই অংশ দান করেন, যা তিনি অন্যদের দিয়েছিলেন। আল-সুরায়ের ও খাচ নামের দুই উপত্যকা, যার মাধ্যমে খায়বারের অঞ্চলগুলো ছিল বিভক্ত। নাটা ও আল-শিইখ এর ১৮ শেয়ার, যার মধ্যে নাটার ছিল পাঁচটি ও আল-শিইকের তেরটি শেয়ার। এই দুই অঞ্চলের অংশগুলো ১,৮০০ ভাগে ভাগ করা হয়।' ---
- অনুবাদ, টাইটেল, [**] ও নম্বর যোগ - লেখক।
>>> আদি উৎসে মুহাম্মদ ইবনে ইশাক, আল-ওয়াকিদি ও আল-তাবারীর ওপরে বর্ণিত বর্ণনায় যে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট, তা হলো, কুরাইশদের সঙ্গে 'হুদাইবিয়া সন্ধি চুক্তি' সম্পন্ন করার পর মদিনায় ফিরে আসার প্রাক্কালে ‘সুরা আল-ফাতাহ' অবতারণা করার মাধ্যমে মুহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের যে লুটের মালের ওয়াদা করেছিলেন, খায়বার জনপদবাসীদের ওপর আগ্রাসী নৃশংস আক্রমণ ও তাঁদের সমস্ত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ লুণ্ঠন ও ভাগাভাগির মাধ্যমে মুহাম্মদ তাঁর সে ওয়াদা পালন করেছিলেন। বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও যেমন আটজন ব্যক্তিকে মুহাম্মদ বদর যুদ্ধে অর্জিত লুটের মালের হিস্যা প্রদান করেছিলেন, তেমনই খায়বার অভিযানে অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও মুহাম্মদ তাঁর হুদাইবিয়া যাত্রায় অংশগ্রহণকারী অনুসারীদের খায়বার অভিযানে অর্জিত লুটের মালের হিস্যা প্রদান করেছিলেন। এমনকি তাঁদের যে দুইজন ব্যক্তি ইতিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তাঁদের পরিবার পরিজনদেরও মুহাম্মদ এই লুটের মালের হিস্যা প্রদান করেছিলেন। বদর যুদ্ধে [পর্ব: ৩০-৪৩] অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও যে আটজন ব্যক্তিকে মুহাম্মদ বদর যুদ্ধে অর্জিত লুটের মালের হিস্যা প্রদান করেছিলেন, তারা হলেন: [4]
তিনজন মুহাজির (আদি মক্কাবাসী মুহাম্মদ অনুসারী):
(১) মুহাম্মদের জামাতা উসমান ইবনে আফফান - মুহাম্মদ তাঁকে তাঁর অসুস্থ স্ত্রী রুকাইয়া বিনতে মুহাম্মদের সেবা শুশ্রূষার জন্য মদিনায় থাকতে বলেছিলেন। যে দিন যায়েদ বিন হারিথা বদর যুদ্ধ বিজয়ের খবর নিয়ে মদিনায় হাজির হন, সেই দিন মুহাম্মদের এই কন্যা রুকাইয়ার মৃত্যু হয়;
(২) তালহা বিন উবায়েদু্ল্লাহ (Talha b Ubaydullah) ও
(৩) সাইদ বিন যায়েদ বিন আমর বিন নুফায়েল (Said b Zayd b Amr b Nufayl)।
পাঁচ জন আনসার (আদি মদিনা-বাসী মুহাম্মদ অনুসারী):
(৪) আবু লুবাবা বিন আবদ আল-মুনধির (Abu Lubaba b Abd al-Mundhir);
(৫) আসিম বিন আদি (Asim b Adi);
(৬) আল-হারিথ বিন হাতিব (Al-Harith b Hatib);
(৭) খাওয়ায়েত বিন জুবায়ের (Khawwat b Jubayr) ও
(৮) আল-হারিথ বিন আল-সিমমা (al-Harith b al-Simma)।
[**] খায়বার-বাসীদের মতই 'ফাদাক'-এর লোকদের ওপর আক্রমণ করা হবে - এমন হুমকির মাধ্যমে মুহাম্মদ কীভাবে তাঁদের সমস্ত সম্পত্তি হস্তগত করেছিলেন তার বিস্তারিত আলোচনা খায়বার যুদ্ধ-পরবর্তী ‘ফাদাক অধ্যায়’ পর্বগুলোতে করা হবে।
ইসলামী ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকে আজ অবধি প্রায় প্রতিটি ইসলাম বিশ্বাসী প্রকৃত ইতিহাস জেনে বা না জেনে ইতিহাসের এ সকল অমানবিক অধ্যায়গুলো যাবতীয় চতুরতার মাধ্যমে বৈধতা দিয়ে এসেছেন। বিষয়গুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিধায় বাংলা অনুবাদের সাথে আল-ওয়াকিদির মূল ইংরেজি অনুবাদের অংশটিও সংযুক্ত করছি। ইবনে ইশাকের মূল ইংরেজি অনুবাদ ইন্টারনেটে বিনামূল্যে ডাউনলোড লিঙ্ক: তথ্যসূত্র [2]।
The detailed narrative of Al-Waqidi (continued): [1]
They said: A fifth was for the Messenger of God from all the plunder that the Muslims took, whether the Messenger of God witnessed it or not. But there was no portion in the plunder for those who were not present, if they did not witness it; except at Badr where he gave to eight who did not witness, and [Page 684] each had a right to it. And Khaybar was for the people of al-Ḥudaybiyya, too, those who witnessed it among them or were absent from it. God promises you plunder in plenty take it when he hastens this for you (Q. 48:20): referring to Khaybar. Men who had stayed behind from Khaybar were Murayy b. Sinān, Ayman b. ‛Ubayd, and Sibā‛ b. ‛Urfuta al-Ghifārī. He appointed Jābir b. ‛Abdullah and others to take his place in Medina. Two of them died. The Messenger of God apportioned to those who stayed behind and those who died.
He apportioned to those who witnessed Khaybar among people who did not witness al-Ḥudaybiyya. He apportioned to messengers who were appointed to the people of Fadak, Muḥayyisa b. Mas‛ūd al-Ḥārithī, and others. The Messenger of God apportioned to those who attended, but also to three sick people who did not attend the battle: Suwayd b. al-Nu‛mān, ‛Abdullah b. Sa‛d b. Khaythama, and a man from the Banū Khuṭāma. And he apportioned to the dead who were killed among the Muslims.
Ibn Abī Sabra related to me from ‛Abd al-Raḥmān b. ‛Abdullah b. ‛Abd al-Raḥmān b. Abī Ṣa‛ṣa‛a that a sayer had said: Indeed Khaybar was for the People of Ḥudaybiyya.Others than them did not witness it, and others than them were not given a portion of it. The first saying is confirmed with us, that a people who witnessed Khaybar were given portions even though they had not witnessed al-Ḥudaybiyya.
(চলবে)
তথ্যসূত্র ও পাদটীকা:
[1]“কিতাব আল-মাগাজি”- লেখক: আল-ওয়াকিদি (৭৪৮-৮২২ খৃষ্টাব্দ), ed. Marsden Jones, লন্ডন ১৯৬৬; ভলুম ২, পৃষ্ঠা ৬৮৩-৬৮৪; ইংরেজি অনুবাদ: Rizwi Faizer, Amal Ismail and Abdul Kader Tayob; ISBN: 978-0-415-86485-5 (pbk); পৃষ্ঠা ৩৩৬-৩৩৭
[2]“সিরাত রসুল আল্লাহ”- লেখক: মুহাম্মদ ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদনা: ইবনে হিশাম (মৃত্যু ৮৩৩ খৃষ্টাব্দ), ইংরেজি অনুবাদ: A. GUILLAUME, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচী, ১৯৫৫, ISBN 0-19-636033-1, পৃষ্ঠা ৫২১
[3] অনুরূপ বর্ণনা:“তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক”- লেখক: আল-তাবারী (৮৩৮-৯২৩ খৃষ্টাব্দ), ভলুউম ৮, ইংরেজী অনুবাদ: Michael Fishbein, University of California, Los Angeles, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৭, ISBN 0-7914-3150—9 (pbk), পৃষ্ঠা (Leiden) ১৫৮৮-১৫৮৯
[4] Ibid “কিতাব আল-মাগাজি”- ভলুম ১, পৃষ্ঠা ১০১; ইংরেজি অনুবাদ: পৃষ্ঠা ৫১
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন