প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি থাকলেই কি কাউকে শিক্ষিত বলা উচিত, যদি সে মুক্তচিন্তা করতে না পারে? পাঠ্যপুস্তক পড়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করাটাই কি শিক্ষিত হবার পরিচায়ক? যুক্তি-প্রমাণহীন কোনও বিশ্বাস ভেঙে যাবে বলে প্রশ্ন করতে ভীত শিক্ষিত ব্যক্তির শিক্ষার মূল্য কতোটা? নিজের ধারণার পরিপন্থী কোনও সত্যকে অস্বীকার করা ব্যক্তিকে সুশিক্ষিত বলা যাবে কি, যদি তার থেকে থাকে সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও?
আরজ আলী মাতুব্বর - প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন, তবে স্বশিক্ষিত, সুশিক্ষিত ও কুসংস্কারমুক্ত ছিলেন বলে মুক্তচিন্তা করতে পারতেন। ধর্মীয় রীতিনীতি ও কুসংস্কার বিষয়ে যতো প্রশ্ন এসেছে তাঁর যুক্তিমনস্ক মস্তিষ্কে, তিনি সেসবের উত্তর খুঁজেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন, প্রচ্ছন্ন সরস কটাক্ষ করেছেন। তিনি তাঁর লব্ধ জ্ঞান ও নিজস্ব অনুসন্ধিৎসু বুদ্ধিবৃত্তির অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে রচনা করেছেন কয়েকটি বই। তাঁর ভাষাজ্ঞান, রসবোধ রীতিমতো ঈর্ষাজাগানিয়া।
বাংলাদেশের এই দার্শনিক ও চিন্তাবিদ আরজ আলী মাতুব্বরের জন্মদিন আজ। এ উপলক্ষে তাঁর সবচেয়ে পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ রচনা "সত্যের সন্ধান"-এর ইবুক প্রকাশ করা হচ্ছে আধুনিকতম অবয়বে। বইটির বিভিন্ন অনলাইন ভার্শন বহু বছর ধরে লভ্য হলেও সেটির সবচেয়ে সুদর্শন, সবচেয়ে ঝকঝকে এবং সবচেয়ে দৃষ্টিসুখকর ইবুক ভার্শন প্রকাশ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করাই ছিলো আমাদের উদ্দেশ্য। "নরসুন্দর মানুষ" নামের এক অমানুষ বইটি ইউনিকোডে টাইপ করে হাইলাইট করেছেন বিশেষ অংশগুলো এবং বানিয়েছেন অনিন্দ্যসুন্দর ইবুকটিও। মূল বইয়ে আরজ আলী মাতুব্বর-এর নিজের আঁকা সাদা-কালো কাভারটির চমৎকার "কাভার ভার্শন" করে "কবি" বানিয়েছেন প্রচ্ছদ। নরসুন্দর মানুষ ভূমিকায় লিখেছেন:
প্রতিদিন ১১ কিলোমিটার দূর থেকে হেঁটে বরিশাল লাইব্রেরিতে এসে বই পড়ে আবার সন্ধ্যায় পায়ে হেঁটে বাড়িতে ফিরে যেতেন তিনি; অন্য পাঁচ-দশটা গ্রাম্য শিশুর মতই অতি দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম তাঁর; সামান্য ভিটেবাড়ি ছাড়া উত্তরাধিকার সূত্রে কিছুই পাননি তিনি; বাবাকে হারান শৈশবেই।
পিতৃহীন ‘আরজ আলী মাতুব্বর’ মায়ের ছায়ায় বড় হচ্ছিলেন। বাংলা ১৩৩৯ সনে সেই মাকে হারিয়েও প্রচণ্ড আঘাত পান, আরজ আলী তখন যৌবনে দাঁড়িয়ে; মৃত মায়ের একটি ছবি তোলার অপরাধে মায়ের জানাজা হলো না; এক ধাক্কায় আরজ আলী’র মনন থেকে উঠে আসতে শুরু করলো ধর্ম, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, জগৎ ও জীবন নিয়ে নানা জিজ্ঞাসা। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লাইব্রেরিতে পড়াশোনা শুরু করেন, কিন্তু তাঁর মনে জেগে ওঠে প্রশ্নের পর প্রশ্ন; আলোড়িত প্রশ্নগুলো লিখে রাখতে শুরু করেন, আর এভাবেই লিখে ফেলেন তার প্রথম বই ‘সত্যের সন্ধান’, এটি বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে।
আরজ আলী মাতুব্বর ছিলেন স্বশিক্ষিত বস্তুবাদী দার্শনিক; বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব সবক্ষেত্রেই ছিল তাঁর আলোকিত পদচারণা, ৮০ তম জন্মবার্ষিকীতে জীবনের সমূদয় উপার্জন দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি’, মানবকল্যাণে নিজ দেহ ও চোখ দান করে গিয়েছিলেন; জ্ঞানার্জনে শিক্ষার কোনো বিকল্প হতে পারে না - এই সত্যটি উপলব্ধি করে আমৃত্যু জ্ঞানান্বেষণে ছুটে বেড়িয়েছেন তিনি।
মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বত্তার মূল ভিত্তি হচ্ছে মানবীয় উৎকর্ষতা ও যৌক্তিক-বিশ্লেষণার্থক চিন্তার প্রসারতা। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত মানুষের চেয়ে তাই আমাদের বেশি প্রয়োজন স্বশিক্ষিত আলোকিত মানুষের। কালের ক্রমবিকাশে লৌকিক স্বশিক্ষিত মানুষেরাই হয়ে দাড়িয়েছেন মহাজাগতিক আলোকবর্তিকা, যাঁরা ছাড়িয়ে গেছেন সময়কে। ‘আরজ আলী মাতুব্বর’ সেই লৌকিক স্বশিক্ষিত দার্শনিক, যাঁর দর্শন এখনো বহুমাত্রিক কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেদ করে যৌক্তিক মুক্তির সন্ধান দেয় আমাদের। তাঁর হাত ধরে আজও আমরা খুঁজে নিতে পারি মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, বিজ্ঞানমস্কতার উত্তরণ।
‘আরজ আলী মাতুব্বর’-এর ১১৬ তম জন্মদিনে তাঁর প্রশ্নের আলোয় আলোকিত হবার চেষ্টাই হতে পারে আমাদের উত্তরণের ব্রত। শুভ জন্মদিন, অগ্রজ।
এ এমন এক বই, যেটা পড়া না থাকলে অতিঅবশ্যপাঠ্য। এমনকি পড়া থাকলেও বারবার পাঠে বিরক্তি জাগে না একবিন্দু, ম্লান হয় না মুগ্ধতা।
ফরম্যাট: পিডিএফ
ফরম্যাট: পিডিএফ
সাইজ: ১.৯ মেগাবাইট
ডাউনলোড লিংক (গুগল ড্রাইভ): https://goo.gl/hGF9xW
ডাউনলোড লিংক (ড্রপবক্স): https://goo.gl/7vkU7Q
অনলাইনে পাঠযোগ্য ভার্শনও এমবেড করা হলো নিচে:
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন