লিখেছেন উজান কৌরাগ
পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫ > পর্ব ৬ > পর্ব ৭ > পর্ব ৮ > পর্ব ৯ > পর্ব ১০ > পর্ব ১১ > পর্ব ১২ > পর্ব ১৩ > পর্ব ১৪ > পর্ব ১৫
বললাম, ‘আপনি আমার পূর্বপুরুষ, আপনার বংশের সর্বশেষ প্রতিনিধি আমি।’
বললাম, ‘আপনি আমার পূর্বপুরুষ, আপনার বংশের সর্বশেষ প্রতিনিধি আমি।’
তিনি ধীরে ধীরে পাথর থেকে নেমে এসে আমাকে প্রদক্ষিণ করতে করতে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। আমিও পর্যবেক্ষণ করছি আমাকে প্রদক্ষিণরত আমারই পূর্বপুরুষকে, যার শরীরে একটা সুতো পর্যন্ত নেই! নগ্ন তিনি; আমি দৃষ্টি রাখছি তার মুখে, বুকে, পেটে, পিঠে, নিতম্বে, ঊরুতে, পায়ের পাতায়, এমনকি কাঁচা-পাকা কেশাবৃত শিশ্নেও! কিন্তু কী আশ্চর্য, তাকে দেখে আমার একটুও লজ্জা লাগছে না, তিনিও লজ্জিত বোধ করছেন না! তাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে, আমার মতো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন ব’লে তিনি অশিক্ষিত; নগ্ন ব’লে মনে হচ্ছে না তিনি অসভ্য-অশালীন! তার নিম্নাঙ্গের কেশের ভেতর থেকে নেতিয়ে ঝুলে থাকা শিশ্নটাকে অশ্লীলতার ধ্বজা ব’লে মনে হচ্ছে না আমার। বরং মনে হচ্ছে তিনি স্বাভাবিক, সত্য, সুন্দর!
আমি ভাবতে লাগলাম, আচ্ছা, আমি যদি আমার বাবা কিংবা চাচাকে এরকম নগ্ন অবস্থায় দেখতাম, তাহলে আমার কী মনে হতো? তাহলে আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যেতাম, কয়েকটা দিন হয়তো তাদের সম্মুখে যেতে চাইতাম না, না চাইলেও মনের আয়নায় বারবার ভেসে উঠতো নগ্ন দৃশ্য। মনে হতো, কী অশ্লীল, কী অশালীন দৃশ্য! অথচ বাবা-চাচারই পূর্বপুরুষকে সম্পূর্ণ অনাবৃত অবস্থায় দেখেও আমার কিন্তু তেমন অনুভূতি হচ্ছে না! হয়তোবা সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অশ্লীলতা ঢুকে পড়েছে আমাদের মগজে, আমাদের চৈতন্যে ছড়িয়েছে অশ্লীলতাবোধ, আমাদের দৃশ্যমান লিঙ্গ কোমরের নিচে থাকলেও অদৃশ্য লিঙ্গ পাল তুলে ছুটছে মগজের কোষে কোষে। আমাদের মনন গ্রাস করেছে অস্বাভাবিক, অসত্য আর অসুন্দর তত্ত্বে; অথচ এই তত্ত্বকেই আমরা মেনে নিয়েছি স্বাভাবিক, সত্য আর সুন্দর ব’লে। কাল আমাদের গায়ে পরিয়ে দিয়েছে সুন্দর চাকচিক্য পোশাক, কিন্তু আমাদের অন্তরকে করেছে অসভ্য-অশালীন!
এবার আমার পূর্বপুরুষ আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তিনি দুই হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন আমার শ্মশ্রুমুণ্ডিত মুখমণ্ডল, চুল। তিনি হাত রাখলেন আমার বুকে, কান পাতলেন। তিনি কি আমাকে পরীক্ষা ক’রে দেখছেন যে, আমিই তার উত্তরপুরুষ কি না! কী জানি! এবার তিনি আমার হাত ধরলেন, একটা একটা ক’রে হাতের আঙুল টিপে দেখলেন। আমার ডান হাতটা রাখলেন তার শ্মশ্রুময় গালে। আমি দেখলাম, তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে! আমি স্থির, স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি তাঁর দিকে। কোনো কথা বলতে পারছি না। আমিও কিছুটা আবেগাপ্লুত, আমার চোখও ছলছল করছে। হয়তোবা মনের আনন্দে-আবেগে, হঠাৎ-ই তিনি আমার হাত ছেড়ে ময়লা দাঁতগুলো বের ক’রে নিঃশব্দে হাসতে হাসতে নাচতে লাগলেন। তারপর আচমকাই আবার নাচ থামিয়ে দৃষ্টি স্থির করলেন আমার শরীরের পোশাকের দিকে; শার্ট, শার্টের পকেট, বোতাম, কলার, প্যান্ট, প্যান্টের পকেট ইত্যাদি হাত দিয়ে ধরে ধরে দেখতে লাগলেন; অজান্তেই তিনি প্যান্টের চেইন ধরে টান দিলে প্রথমে একটুখানি খুললো, তারপর আরেকটু টান দিলে পুরোটা খুলে গেল; এরপর বেশ কয়েকবার চেইন খুললেন এবং লাগালেন। প্যান্টের চেইন ছেড়ে আমার পায়ের কাছে বসে জুতোয় হাত বুলাতে লাগলেন; বিস্ময়ে বারবার নিজের পায়ের পাতায়-আঙুলে এবং আমার জুতোয় হাত বুলাতে লাগলেন। উঠে দাঁড়িয়ে পুনরায় আমার গায়ে হাত বুলিয়ে, আঙুল দিয়ে শার্টের কাপড় ধরে দেখতে লাগলেন। আমি বললাম, ‘মানুষ এখন সভ্য হয়েছে; এখন মানুষ পোশাক পরে, স্কুল-কলেজে গিয়ে শিক্ষা অর্জন করে, পৃথিবীটা অনেক বদলে গেছে। আপনার পরবর্তী বংশধরদের আমাদের ভূ-খণ্ডে পৌঁছতে অনেককাল লেগেছিল, আর এখন আমাদের ভূ-খণ্ড থেকে বিমানে চড়ে একদিনেই এখানে আসা সম্ভব।’
তার মুখের বিস্ময় আর আনন্দ উবে গেল, তিনি গম্ভীর হলেন। বললাম, ‘আচ্ছা, আপনার ধর্ম কী? আমরা সভ্য মানুষেরা তো এখন সাড়ম্বরে অনেক রকম ধর্ম পালন করি, আপনারা কি সেরকম কিছু পালন করতেন?’
এবার আচমকা তার মুখাবয়বের ভাষা বদলে গেল; একটু আগে যে মুখে ছিল বিস্ময় আর আনন্দ, এখন সেখানে ফুটে উঠেছে ক্ষুব্ধতা, দু'চোখের ভাবুক-স্নিগ্ধ দৃষ্টি হয়ে উঠেছে ক্ষিপ্র! তিনি একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন, তারপর ক্ষিপ্র হাতে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন আমার শার্টের হাতা। শার্টের প্রতি তার কৌতূহল দেখে আমি নির্বোধের মতো ভাবলাম তিনি বোধ হয় আমার শার্টটা পছন্দ করেছেন, হয়তো শার্টটা গায়ে দিতে চান। আমি শার্টটা গা থেকে খুলে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম, ‘এটা রাখুন, আপনি পরবেন। রোদ এবং শীত থেকে আপনাকে কিছুটা সুরক্ষা দেবে।’
শার্টের দিকে তাকিয়ে তিনি আরও বেশি ক্ষুব্ধ হলেন আর তার দৃষ্টি হয়ে উঠলো আরও চঞ্চল! ক্ষিপ্র হাতে তিনি আমার হাত থেকে শার্টটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন মাটিতে। আমাকে অবাক ক’রে তিনি দু-হাতে তার শিশ্ন উঁচিয়ে মূত্র বিসর্জন করলেন শার্টটার ওপর! তার মূত্রবিসর্জন শেষ হওয়ামাত্র তিনি দৌড় দিলেন অরণ্যের দিকে এবং নিমিষের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন অরণ্যের গাঢ় সবুজ শরীরে। বেশ কয়েক মুহূর্ত পর আমি অরণ্যের দিক থেকে দৃষ্টি গুটিয়ে আনলাম মূত্রস্নাত শার্টটার ওপর। শার্ট কোথায়, তিনি তো আমাদের আধুনিক সভ্যতা আর সভ্য মানুষের ধর্মের ওপর মূত্র বিসর্জন ক’রে গেছেন!
মাগরিব-এর আযানের কর্কশ সুর আমার মনের হলদে পাখিটাকে ফিরিয়ে আনলো দাদার কবরে। সূর্য ডুবে গেলেও এখনো চারিদিকে আদুরে আলোর পরশ। কবরস্থান এখন সুনসান, কোনো মানুষজন নেই। কবরস্থানের অফিসের লোকজনও হয়তো এখন ভেতরে ইফতারে ব্যস্ত। আমি শেষবারের মতো দাদার কবর স্পর্শ ক’রে উঠে দাঁড়ালাম। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম অন্য একটি কবরের দিকে। এখানে বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকের কবর আছে। জীবদ্দশায় তাদের কাউকে কাউকে আমি দেখেছি, দু'-একজনের সঙ্গে কথাও বলেছি। কবরস্থানে এলেই দাদার কবরে শ্রদ্ধা জানানোর পর আমি আমার পছন্দের কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকের কবরে শ্রদ্ধা জানাই, তাঁদের সৃষ্টির অতলে ডুব দিয়ে কথা বলি তাঁদের সঙ্গে। আসলে জীবিত কবি-সাহিত্যিকদের চেয়ে মৃত কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দৃঢ়! তাঁদেরকে আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি এজন্য যে, তাঁরা অবিমৃশ্যকারী বা মিথ্যাবাদী নন; আর যেখানে অবিমৃশ্যকারিতা নেই, সাজানো মিথ্যার চাষ নেই, সেখানেই আমার সম্পর্ক দৃঢ় হয়। আমি একজন উঠতি লেখক হলেও বিখ্যাত শিল্পী বা কবি-সাহিত্যিকদের সাহচর্য আজকাল এড়িয়ে চলি। কারণ এই যে তাদের সঙ্গে কিছুদিন মেলামেশার পরই তাদের স্বভাবের উৎকট দুর্গন্ধ আমার চিত্তকে আহত করে। দেখি যে, তারা পরিবারে, ঘরোয়া আড্ডায়, সাহিত্যসভায় কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় ভিন্ন ভিন্ন মুখোশ প’রে অবতীর্ণ হন। তাদের চরিত্রের বৈপরীত্য দেখে, তাদের দ্বিচারিতা দেখে আমি রীতিমতো হাঁ হয়ে যাই! আমি তাদের সৃষ্টির সঙ্গে মানুষটিকে কিছুতেই আর মেলাতে পারি না। অধিকাংশের ভেতরেই প্রভু হবার বিপুল বাসনা, বন্ধু হতে চায় না কেউ। অধিকাংশই একে অন্যের কুৎসা করে আর তিন পেগ তরল আগুন পেটে পড়লেই অন্যকে গালাগালি করে, অন্যের সৃষ্টি খারিজ ক’রে দিয়ে বোঝাতে চায় যে, আমি যা সৃষ্টি করেছি, তাতে এরই মধ্যে আমার অমরত্ব নিশ্চিত! এইসব নানাবিধ কারণে তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা কিছুতেই অটুট রাখতে পারিনি, আর তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাও আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে আমি সকল সঙ্গ ত্যাগ ক’রে একলা চলার নীতি গ্রহণ করেছি। আর এই উপলব্ধি আমার হয়েছে যে, বিখ্যাতজনদের বেশি ঘনিষ্ঠ হতে নেই, তাতে পিঠ চাপড়ানি জুটলেও নিজের প্রতিভা নষ্ট হবার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। বুঝেছি যে, অন্য অনেক কর্মের মতো সৃজনশীল কর্মও একটা দক্ষতা; একজন ব্যক্তি নিজেকে ঘষামাজা করতে করতে একটা পর্যায়ে গিয়ে হয়তো সৃজনশীলতায় দক্ষ হয়ে ওঠেন, তিনি দারুণ কিছু সৃষ্টি করতে পারেন। কিন্তু তিনি দারুণ কিছু সৃষ্টি করছেন মানেই যে, তিনি নিজের ভেতরের বিশ্বাস থেকে করছেন বা ব্যক্তি মানুষটির সততাই যে তার সৃষ্টিতে প্রতিফলিত হচ্ছে, এমনটা ভাবা মানে বোকার স্বর্গে বাস করা, আমি অনেকদিন ওই বোকাস্বর্গে বাস করেছি! আসলে সবই ওই দক্ষতা, একজন পকেটমার যেমন চেষ্টা করতে করতে দক্ষ হয়ে ওঠে, সৃজনশীল মানুষও তাই। দক্ষ হলেই যে তার ভেতরে সততা থাকবে, তিনি একজন সৎ মানুষ হবেন, তা নয়; তার সৃষ্টির সততা, ভালমানুষিতা, মিষ্টবচন, মহানুভবতা ইত্যাদি সবই আরোপিতও হতে পারে। দক্ষতা অর্জন করলে সৃষ্টিতে নানান গুণের শীলিত বিন্যাস সম্ভব। এসব বুঝতে আমার বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছে। আর বোঝার পরেই বিখ্যাত ব্যক্তির সাহচর্য পাবার মোহ আমার কেটে গেছে। মনে হয়েছে যে, বিখ্যাত ব্যক্তির কাছ থেকে দূরে থেকে কেবল তার সৃষ্টির রস আস্বাদন করাই উত্তম, কাছে এলেই বিপদ। তার সৃষ্টির প্রতিও বিতৃষ্ণা জন্মায়। অবশ্য সবাই যে এই রকম, তা নয়, সংখ্যায় খুব কম হলেও কেউ কেউ আছেন ব্যতিক্রম, যাঁদের মুখের ওপর আলাদা মুখোশ নেই; আমি দূরে থেকেও শ্রদ্ধাভরে তাদের সামনে নতজানু হই!
মাস ছয়েক আগে একজন কবি পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তখন। সেই সূত্রে তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সমাজভাবনা-বিশ্ববীক্ষা অনেক বিষয়েই আমি জানতাম। মুসলমানের সন্তান হলেও তিনি নামাজ পড়েন না, রোজা রাখেন না, সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন না। ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সময় মোল্লাদের গালাগাল করতেন, কোরানকে আখ্যা দিতেন মোহাম্মদের পাগলের প্রলাপ ব’লে, মোহাম্মদকে বলতেন জঙ্গিবাদের জনক, আড্ডার মাঝখানে বা কবিতা পড়ার সময় আযান শুরু হ’লে বিরক্ত হয়ে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ ব’লে মুয়াজ্জিনকে গালি দিতেন। অথচ সেই তিনি প্রবন্ধে এই কথাগুলো লিখেছিলেন যে, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে না। একটি স্বার্থান্বেষী মহল পবিত্র কোরানের ভুল ব্যাখ্যা ক’রে দেশে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম চালাচ্ছে।’ আমি রীতিমতো থ হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর লেখা পড়ে! কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় তার বাসায় ব্যক্তিগত আড্ডায় আমি কোরান-হাদিসের কয়েকটি আয়াত তাঁর সামনে তুলে ধরেছিলাম। আয়াতগুলো হলো:
‘অতএব যখন তোমরা অবিশ্বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে মোকাবিলা কর তখন তাদের ঘাড়ে-গর্দানে আঘাত করো। শেষ যখন তোমরা ওদেরকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করবে তখন ওদেরকে শক্ত ক’রে বাঁধবে। তারপর তোমরা ইচ্ছে করলে ওদেরকে মুক্ত ক’রে দিতে পারো বা মুক্তিপণ নিয়েও ছেড়ে দিতে পারো। যতোক্ষণ না ওরা অস্ত্র সংবরণ করে, তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। এ-ই বিধান। এজন্য যে আল্লাহ্ ইচ্ছা করলে ওদেরকে শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি চান তোমাদের এককে অপরকে দিয়ে পরীক্ষা করতে। যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তিনি কখনই তাদের কাজ নষ্ট হতে দেননা।’ আল কোরান, সুরা মুহাম্মদ (৪৭:৪)।
‘স্মরণ করো, তোমাদের প্রতিপালক ফেরেশতাদের ওপর প্রত্যাদেশ করেন, “আমি তোমাদের সাথে আছি, সুতরাং বিশ্বাসীদেরকে সাহস দাও।” যারা অবিশ্বাস করে আমি তাদের হৃদয়ে ভয় ঢুকিয়ে দেব। সুতরাং তোমরা তাদের ঘাড়ে ও সারা অঙ্গে আঘাত করো।’ আল কোরান, সুরা আনফাল (৮: ১২)।
‘তোমরা তাদেরকে হত্যা করোনি, আল্লাহ তাদেরকে মেরেছিলেন, আর তুমি যখন (কাঁকর) ছুড়েছিলে তখন তুমি ছোড়োনি, আল্লাহ-ই তা ছুড়েছিলেন; তার তা ছিল অবিশ্বাসীদেরকে ভাল পুরস্কার দেওয়ার জন্য। নিশ্চয় আল্লাহ সব শোনেন, সব দেখেন।’ আল কোরান, সুরা আনফাল (৮:১৭)।
‘যারা আমার উদ্দেশে জিহাদ করে আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করবো। আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে থাকেন।’ আল কোরান, সুরা আনকাবুত (২৯:৬৯)।
হাদিস থেকেও উল্লেখ করেছিলাম নবী মুহম্মদের উক্তি:
‘আমি বাদ্য-যন্ত্র ও মুর্তি ধ্বংস করার জন্যে প্রেরিত হয়েছি।
তারপর তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আমি জানি, এই আয়াতগুলোসহ কোরান-হাদিসের আরো অনেক ধ্বংসাত্মক উক্তি সম্পর্কে আপনি অবগত, ধর্ম সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত বিশ্বাসও আমি জানি, সব জেনেও অমন একটি স্ববিরোধী প্রবন্ধ আপনি কেন লিখলেন?’
তখন তার চার পেগ চলছে, আমার প্রশ্ন শুনে বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর তিনি গড়গড় ক’রে এই বিষয়ে যে দীর্ঘ বয়ান আমাকে দিয়েছিলেন. তার সারসংক্ষেপ এইরকম - ‘প্রবন্ধটা আমি নিজের ইচ্ছায় লিখিনি। ওটা ছিল একটা ফরমায়েশি কাজ। পত্রিকা থেকে জঙ্গিবাদের বিপক্ষে এই ধরনের একটা প্রবন্ধ আমাকে লিখতে বলা হয়েছিল, কেননা ওরা জানে যে, পাঠকের ওপর আমার বেশ প্রভাব আছে। ওদের প্রস্তাবে আমি না করতে পারিনি; কারণ, ওরাই আমাকে প্রমোট করে বড় কবি বানিয়েছে। যে পাঁচ-দশজন মানুষ আজ আমাকে চিনছে-জানছে বা সম্মান করছে, যে সকল প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন আমাকে সম্মাননা জানাচ্ছে, তা ওদের জন্য। তাই ওদের প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিতে পারিনি। নইলে ধর্ম বিষয়ে বরাবরই আমি চুপ থাকি। ধর্ম সম্পর্কে সত্য কথা শোনার মতো সুশিক্ষিত এবং সহনশীল নয় আমাদের সমাজ। আমাদের সমাজ মিথ এবং মিথ্যায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, মস্তিষ্কের কোষে বংশ পরম্পরায় বহন ক’রে চলেছে কুসংস্কার। প্রগতি এবং সত্যের জন্য আমাদের সমাজ এখনো তৈরি হয়নি। ফলে ধর্মটাকে পুঁজি ক’রে বাণিজ্য ক’রে নিচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, গণমাধ্যমের লোকজন। আর তার বলি হচ্ছে কারা জানো? আমরা, আমার মতো কিছু প্রগতিশীল মানুষ; গণমাধ্যম যাদেরকে আখ্যা দিয়েছে বুদ্ধিজীবী, সমাজের মানুষও আমাদের সেভাবেই চেনে। যেহেতু আমাদের ভেতরেও অদম্য নেশা ও আশা থাকে জনপ্রিয় হওয়ার, গণ্যমান্য বুদ্ধিজীবীর কাতারে পৌঁছানোর, ঘন ঘন পত্রিকায় লেখা ছাপানোর, সাক্ষাৎকার প্রদানের, সভা-সমিতির চেয়ার অলংকৃত করার; ফলে ওরা আমাদের এই দুর্বল জায়গাটাকে ব্যবহার করে ওদের ব্যবসায়িক স্বার্থে, কারণ ওদের টেলিভিশন কিংবা সংবাদপত্রের জন্য আসল হোক বা নকল হোক বুদ্ধিজীবী তৈরি করা প্রয়োজন। রাজনীতিবিদদেরও বুদ্ধিজীবী প্রয়োজন তাদের সভাসমিতির ঔজ্জ্বল্য বাড়ানো এবং তাদের গুণগান করবার জন্য। এজন্য ওরা আমাদের সামনে লোভের জাল বিছায়, আর আমরা সহজেই তাতে জড়িয়ে পড়ি। একবার জালে জড়িয়ে গেলে আর বের হবার উপায় থাকে না। তুমি বের হতে চাইলেও লোভ তোমাকে বের হতে দেবে না। যার ফলে সমস্ত সত্য নিজের মধ্যে গোপন ক’রে একটা দুধভাত টাইপের বুদ্ধিজীবীর ভেক ধ’রে থাকতে হয়। তবে এখন এটাই সিস্টেম হয়ে দাঁড়িয়েছে বুঝলে, সমাজ তো চিরকাল একই রীতিনীতি আর মূল্যবোধ নিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না; আজ যা আমরা অনৈতিক ব’লে ভাবছি, কাল হয়তো তাই-ই নৈতিক হিসেবে স্বীকৃতি পাবে; পেয়েছেও তাই। পুঁজিবাদের এই ঘোড়দৌড়ের দিনে সবকিছু দ্রুত ভেঙেচুরে যাচ্ছে; অন্যায়, অনৈতিকতার ওপরে পুঁজিবাদের জৌলুসের রঙ পড়ে তা শুদ্ধ হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাচ্ছে। অনেকটা গায়ে-মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে পাপমোচনের মতো। পুুঁজিবাদ হচ্ছে আধুনিক যুগের গঙ্গাজল, যে কোনো অন্যায়ের ওপর ছিটিয়ে দেবে, সঙ্গে সঙ্গে তা ন্যায় হয়ে যাবে! ফলে এই সিস্টেমের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।’
প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আত্মগ্লানি হয় না? নিজেকে ঠকানোর জন্য নিজের ওপর ঘৃণা হয় না?’
হো হো ক’রে হেসে উঠেছিলেন তিনি, ‘ধুর! কীসের গ্লানি, কীসের ঘৃণা! অর্থ ও জনপ্রিয়তা এমন এক মাদক, যা একবার তুমি পান করলে ভুলে যাবে সব নীতি-নৈতিকতা! আর বললাম তো, পুঁজিবাদের গঙ্গাজলের কারণে এটাই এখন প্রতিষ্ঠিত নব্য মূল্যবোধ। হ্যাঁ, আগে মাঝে মাঝে খানিকটা আত্মগ্লানি হতো, কিন্তু এখন আর হয় না। কেন হবে? অর্থ পাচ্ছি, আমি যা-ই লিখছি, পাঠক গোগ্রাসে গিলছে। আমার বাপ-দাদা কোনোদিন বিজনেস ক্লাস বাসেই চড়েনি, তাদের ঘরের ছেলে হয়ে আমি সরকারি-বেসরকারি ট্যুরে বিমানে চড়ে সারা বিশ্ব চষে বেড়াচ্ছি। এসব পেতে হলে তোমাকে কলমে লাগাম পরাতেই হবে। তুমি শাসকের বিরুদ্ধে লিখতে পারবে না, ধর্মের বিরুদ্ধেও না। এখন আমি ধর্মের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে লিখলে পাঠক হারাবো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাখ লাখ পাঠক আমাকে ধিক্কার দেবে, গণমাধ্যম আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সরকার আমাকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন কাউকে বসাবে আমার জায়গায়, আমি অচ্ছুৎ হয়ে পড়বো, আমার গর্দানের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরবে চাপাতিবাজরা। কেন জেনে-বুঝে এই আত্মহত্যা আমি করবো! আমার দুটো সন্তান আছে, স্ত্রী আছে; ওরা ভেসে যাবে। তাই আপোস ক’রে বেঁচে থাকা। আর কে না আপোস করছে, বলো? এককালের বাঘা বাঘা সব মার্ক্সবাদীরা এখন এমন ভেক ধরেছে যে, তাদেরকে আর চিনতেই পারি না; মনে হয়, এরা কোনোকালেও মার্ক্সবাদী ছিল না, জন্মলগ্ন থেকেই এরা কট্টর ডানপন্থী! সমাজ এখন দ্রুত পরিবর্তনশীল, তুমি যদি এই পরিবর্তনটা ধরতে না পারো, তবে তুমি বোকা, তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না; তুমি ব্যর্থ হবে। শোনো, কিছু করতে হলে মিডিয়ার সাপোর্ট লাগবেই, মিডিয়া যাকে প্রমোট করে, আমজনতা তাকে নিয়েই হইচই করে, তার বই কেনার জন্য বইমেলায় স্টলের সামনে পাঠকেরা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে; লেখার গুণ নয়, কে বড় লেখক আর কে মাঝারি লেখক, তা নির্ধারণ ক’রে মিডিয়া। সবাই এখন স্রোতের একদিকে ভেসে চলেছে, বুঝলে? যে এই স্রোতে গা না ভাসাবে, সে নির্বোধ! সে সুবিমল মিশ্র; সুবিমল মিশ্র জীবনে কিচ্ছু পায়নি, না অর্থ না জনপ্রিয়তা। স্বীকার করছি যে তিনি দুর্দান্ত লেখেন, আমি তাঁকে শ্রদ্ধাও করি; কিন্তু আমাদের মতো দু'-চারজন লেখক-কবি ছাড়া তাকে কে চেনে, বলো তো!’
গ্লাসে আরেক পেগ ঢালতে ঢালতে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার এখন বয়স কম, তাই নীতি-নৈতিকতা বিষয়ে তুমি অটল। কিন্তু যখন তুমি বিয়ে করবে, সংসার-সন্তান হবে, তখন বুঝবে যে, আমাদের মতো দেশে এইসব নীতি-নৈতিকতা ফালতু আবেগ ছাড়া কিছুই নয়। তখন স্ত্রী-সন্তানের কথা ভেবে জীবন-জীবিকার তাগিদে তুমিও আপোস করবে। তুমি আমার কাছের মানুষ, তাই তোমাকে আগে থেকেই আমি পথ বাতলে দিচ্ছি। অযথা ধর্মের বিরুদ্ধে বা সরকারের বিরুদ্ধে লিখে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরো না। ধর্ম কিংবা রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। সৈয়দ শামসুল হককে দেখ, রাজনীতি গুলে খেয়েছেন! শাসকের সঙ্গে বিটে বিটে পায়ে পা মিলিয়ে পথ চলেছেন, আবার পরিবর্তনটা আঁচ করতে পেরে সঠিক সময়ে পুরনো শাসকের হাত ছেড়ে নতুন শাসকের হাত ধরতেও তাঁর তালভঙ্গ হয়নি; জিন্নাহকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন আবার বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন; কাল এই দেশে খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেই খেলাফতের নায়ককে নিয়েও বীররসে পরিপূর্ণ কবিতা লিখবেন; দিস ইজ স্মার্টনেস! বুদ্ধিমান মানুষেরা সময়ের নার্ভটা সঠিক সময়ে ধরতে জানেন, বুঝলে? তাই তাঁরা সফল হন। ওইসব জোলো এথিকস বাতাসে ভাসিয়ে দাও, নইলে কিচ্ছুটি পাবে না জীবনে, শেষ বয়সে অনুতপ্ত হয়ে নিজের আঙুল নিজে কামড়াবে; কিন্তু তখন হয়তো কিচ্ছু করার থাকবে না। এসব পরামর্শ আমি কাউকেই দিই না, কিন্তু তুমি আমার খুব কাছের মানুষ, লাইক মাই ইয়াঙ্গার ব্রাদার, তোমাকে ভালবাসি, স্নেহ করি, তাই তোমাকে বলছি। জীবনে বেঁচে থাকতে যদি তুমি কিছু না পাও, মরার পর মানুষ তোমাকে মাথায় ক’রে নাচালো না দৌড়লো, তাতে তোমার কিচ্ছু আসে-যায় না!’
আমি আর তাঁকে কিছু বলিনি। কারণ আমি জানি, তিনি যা করছেন সচেতনভাবে জেনে-বুঝেই করছেন। অর্থ, ক্ষমতা আর জনপ্রিয়তার মাদক পান করেছেন তিনি, আমৃত্যু এই নেশা থাকবে। নষ্ট আর বিপথগামী সমাজের অধিকাংশ মানুষ মুখ বুজে সকল অন্যায় মেনে নিয়ে সত্যের পথ থেকে সরে আসে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ভয়ে, একা হবার ভয়ে; কিন্তু এই নষ্ট-ভ্রষ্ট, বিপথগামী আর ক্রমাগত পতোনোন্মুখ সমাজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সত্য ও ন্যায় আঁকড়ে ধরে একা হবার যে কী অপার আনন্দ, কী যে মুক্তির স্বাধীনতা ও সুখ, এই মাথা-বন্ধক-দেওয়া জ্ঞানপাপীরা তা বোঝে না!
আমি একজন কবির কবরের কাছে এসে দাঁড়ালাম। কবি ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন, ব্যক্তিজীবনে নিয়ম মেনে ধর্মকর্ম পালন না করলেও তিনি ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন এবং কিছুটা ইসলাম বাতিক তার ছিল। তাঁর কবিতায় বারবার উঠে এসেছে প্রেম এবং কাম, অথচ ইসলামে এর অনুমোদন নেই। ইসলাম কেবল সেই কবিতাকেই অনুমোদন করে, যা কোরান-হাদিসের মূল্যমান ও মূল্যবোধ এবং ইসলামী ভাবাদর্শ অনুসরণ ক’রে লেখা। মোহাম্মদ কবি লবীদের কবিতা পছন্দ করতেন, কবি লবীদের কবিতার প্রশংসা ক’রে তিনি বলেছিলেন, ‘আরবের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে সত্য কবিতাটি রচনা করেছে লবীদ - জেনে রাখো, আল্লাহ্ ছাড়া আর সবকিছুই বাতিল।’
যদিও কবি লবীদ এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন তথাকথিত জাহেলী যুগে এবং তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে। একবার মোহাম্মদ এবং তার অনুসারীরা মদিনা থেকে আশি মাইল দূরের আরজ নামক এক পল্লীর মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একজন কবি এসে তাদেরকে কবিতা শোনাতে লাগলেন, কবিতা শুনে মোহাম্মদ তার অনুসারীদের বলেছিলেন, ‘এই শয়তানটাকে আটক করো। কবিতা দিয়ে পেট ভরার চেয়ে পুঁজ দিয়ে ভরা ভাল, যে পুঁজ তার যকৃতে পচন ধরায়।’
বর্তমান কালের কোনো কোনো আলেমের মতে, সেই কবির কবিতা অশ্লীল ছিল, তাই মোহাম্মদ তাকে শয়তান আখ্যা দিয়ে আটক করতে বলেছিলেন। কবিতা চর্চা করা মুবাহ, যদি তা ইসলামী আদর্শে লেখা হয় হয়। আবার অনেক আলেমের মতে, কবিতা চর্চা করা মাকরূহ।
বর্তমানে বাংলাদেশে যে ধরনের সাহিত্যের চর্চা হচ্ছে, বলা বাহুল্য যে, তা ইসলামী আদর্শ অনুসরণ ক’রে নয়; বস্তুত ইসলামে শিল্প-সাহিত্য চর্চার পথ রুদ্ধ। তারপরও ইসলামের ছায়াতলে থেকেই এদেশের বহু মানুুষ শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করেছেন এবং এখনো করছেন। গত আড়াই দশক ধরে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ। নানা ধর্মের নানা পেশার মানুষ তাঁর বই কিনেছেন, পাঠ করেছেন। মাদ্রাসার হুজুর থেকে শুরু ক’রে ইংলিশ মিডিয়ামের ইয়ো-ইয়ো ছাত্রও তার পাঠক। আমি অনেক মুসলিম বাসার বইয়ের শেল্ফে দেখেছি কোরান, সহি মুসলিম শরীফ, বোখারী শরীফ, এ ধরণের কয়েকখানা ধর্মীয় বইয়ের পাশে হুমায়ুন আহমেদের হিমু কিংবা মিসির আলী সিরিজের কয়েকখানা বই; এর বাইরে কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষার কয়েকখানা পুরোনো পাঠ্যবই, ইন্টার্নি রিপোর্ট, দু-একখানা ডায়েরি; সারা শেল্ফে এর বাইরে আর কোনো বই নেই; শেল্ফের শূন্যস্থান পূরণ করা হয়েছে দু-একটা ট্রফি কিংবা ক্রেস্ট, মগ-প্লেট, করো ছোটবেলার একখানা বাঁধানো ছবি ইত্যাদি দিয়ে। এই ধরনের বুকশেল্ফ বর্তমান মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানের আভিজাত্য এবং মূল্যবোধের প্রতীক! বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমানের কাছে এখন কোরান-হাদিসের পরেই হুমায়ুন আহমেদের বইয়ের স্থান! হুমায়ুন আহমেদ ধার্মিক ছিলেন, ঈদগায় ঈদের নামাজ পড়ার পর ছেলে কোলে নিয়ে অন্যদের সঙ্গে তার কুশল বিনিময়ের ছবি ফলাও ক’রে ছাপা হয়েছে পত্রিকার পাতায়। একবার একটি সাক্ষাৎকারে তিনি লেখক তসলিমা নাসরিনকে খোঁচা দিয়ে যা বলেছিলেন তার বক্তব্য মোটামুটি এরকম, ‘আমাদের দেশের একজন সাহিত্যিক পশ্চিমাদের কাছে জনপ্রিয় হবার জন্য আমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে লেখে।’
এমন একজন ধার্মিক সাহিত্যিক তার সাহিত্যে যে ধরনের গল্প বলেছেন এবং যেভাবে যৌনতা এনেছেন তা কোনোভাবেই ইসলামসম্মত নয়। কোরান-হাদিসে এ ধরনের সাহিত্য সৃষ্টির অনুমোদন নেই। সম্ভবত তার সৃষ্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র হিমু; সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং মজার ব্যাপার হলো একজন ধার্মিক মানুষ হয়েও তিনি হিমুর গায়ে পরিয়ে দিয়েছেন হারাম পোশাক হলুদ পাঞ্জাবি, মুসলমান পুরুষের জন্য হলুদ পোশাক পরা হারাম! হারাম পোশাক পরেও হিমু তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র, মাদ্রাসার হুজুর থেকে শুরু ক’রে কোটি কোটি ধর্মান্ধ মুসলমান তার বই কিনে পড়েছে এবং বুকশেল্ফে কোরান-হাদিসের পাশে রেখেছে; আর তিনিও তার এই হারাম সৃষ্টির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা রোজগার করেছেন এবং তা দিয়ে হারাম মদ্যপান ও আরামে তার ধর্মপ্রাণ জীবন যাপন করেছেন!
বিচিত্র ধরনের জ্ঞানপাপীর বাস আমাদের এই বাংলাদেশে, বাংলাদেশকে জ্ঞানপাপীদের স্বর্গরাজ্যও বলা যায়! এদেশে ইসলামবিরোধী অনেক কাজ করেও পার পাওয়া যায়, মুসলমানদের মন জয় করা যায় - যদি না ইসলাম সম্পর্কে কেউ সঠিক সত্যটি প্রকাশ করে। ইসলাম সম্পর্কে সঠিক সত্য তথ্য ও ইতিহাস সামনে নিয়ে এলেই তার সমূহ বিপদ; স্বনামে লিখলে হয় তাঁকে জেল খাটতে হয়, নয়তো চাপতির কোপে ঘাড় থেকে মাথাটা নেমে যায়; অথবা স্বাধীনভাবে বাঁচতে হলে তাকে দেশত্যাগ করতে হয়।
পৃথিবীর কোনো ইসলামী রাষ্ট্রেই মুক্তচিন্তক বা ইসলামের সমালোচকের কোনো স্বাধীনতা নেই; জেল, নির্বাসন কিংবা মৃত্যুই তার ভবিতব্য। মুক্তচিন্তার মূলোৎপাটনের এই বীজমন্ত্র প্রোথিত করেছিলেন স্বয়ং মোহাম্মদ মদিনার ইহুদি বানু আমর ইবনে আউফ গোত্রের একশো বিশ বছর বয়সী কবি আবু আফাকের রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। মোহাম্মদ এবং তার শিষ্যরা আল-হারিথ বিন সুয়া’দ বিন সামিত নামের এক ব্যক্তিকে খুন করেছিলেন। এই খুনের প্রতিবাদে কবি আবু আফাক একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতা লিখে তিনি মানুষকে জাগাতে চেয়েছিলেন, যেমনটা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লিখে মানুষকে জাগাতে চেয়েছিলেন রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাস, নিলয় নীল, ওয়াশিকুর রহমান বাবু; মোহাম্মদের বর্তমান শিষ্যরা যাদেরকে নৃশংসভাবে খুন করেছে। একটা মানুষ কতোটা নৃশংস এবং উৎপীড়ক হলে একশো বিশ বছরের একজন বৃদ্ধ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা লিখে মানুষকে জাগানোর চেষ্টা করতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কবি আবু আফাকের কবিতা যাতে মানুষকে প্রভাবিত করতে না পারে, সেজন্যই মোহাম্মদ তাকে খুন জন্য ঘাতক নিযুক্ত করেছিলেন।
শাওয়াল মাসের গরমের রাত, বার্ধক্যপীড়িত কবি ঘরের সামনের আঙিনায় ঘুমিয়ে ছিলেন। হয়তো সে রাতে আকাশে চাঁদ ছিল, হয়তো ছিল না; হয়তো আঙিনার পাশে একটা পোয়াতি খেজুরগাছ ছিল, হয়তো ছিল না। কবি হয়তোবা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন, কিংবা নিমীলিত চোখে করছিলেন বিগত দিনের স্মৃতিচারণা অথবা অপলক চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে সাজাচ্ছিলেন নতুন কোনো কবিতার পংক্তি। আর তখনই মোহাম্মদের শিষ্য ঘাতক সালিম বিন উমায়েরের ধারালো তরবারি গেঁথে যায় কবির বুকে, কলিজা আর পিঠ ফুঁড়ে বেরোয় রক্তমাখা তরবারির মাথা! অসম্পূর্ণই থেকে যায় কবির স্বপ্ন কিংবা স্মৃতিচারণা অথবা পংক্তিমালা!
মোহাম্মদ একইভাবে তার শিষ্য উমায়ের বিন আদি আল খাতমিকে নিযুক্ত করেছিলেন পাঁচ সন্তানের জননী মদিনার কবি আসমা বিনতে মারোয়ানের কলম কলম স্তব্ধ করার জন্য। আসমা ছিলেন বানু উমাইয়া গোত্রের, কিন্তু তিনি বিয়ে করেছিলেন বানু খাতমা গোত্রের ইয়াজিদ বিন জায়েদকে। কবি আবু আফাককে হত্যার পর তিনি ইসলাম ধর্ম, মোহাম্মদ এবং তার শিষ্যদের সমালোচনা করেছিলেন, লিখেছিলেন প্রতিবাদী এবং মানুষের ঘুম-ভাঙানিয়া এক অসীম সাহসী কবিতা। এক অদম্য সাহসী কবি, হত্যভাগ্য জননী; রাতের বেলা পাঁচ সন্তানকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিলেন, কনিষ্ঠ সন্তানকে বুকের দুধ পান করাচ্ছিলেন। সেই অবস্থায় তাঁকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে যায় ঘাতক উমায়ের বিন আদি। আকস্মিক স্তনবৃন্তচ্যুত দুধপানরত সন্তানটি নিশ্চয় কেঁদে উঠেছিল তখন, কিন্তু সে কান্না শুনেও ঘাতক উময়ের বিন আদি’র হৃদয় জাগেনি, তরবারির আঘাতে সে আসমার বুক-পিঠ এফোঁড়-ওফোঁড় ক’রে চিরতরে স্তব্ধ ক’রে দিয়েছিল তাঁর প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। আসমাকে হত্যার পর ঘাতক উমায়ের বিন আদি সংবাদ নিয়ে ভোরবেলা ছুটে গিয়েছিল মোহাম্মদের কাছে, মোহাম্মদ তাকে সঙ্গে নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেছিলেন। তার পর তিনি ঘাতক উমায়ের বিন আদিকে ‘বসির’ অর্থাৎ চক্ষুষ্মান উপাধি দিয়েছিলেন।
বানু নাভান গোত্রের কাব বিন আল-আশরাফও মোহাম্মদের বদরযুদ্ধ, হত্যা, লুণ্ঠনের সমালোচনা ক’রে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। এরপর তিনি এক মুসলমান নারীকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখেছিলেন, যা ইসলামের জন্য অপমানজনক মনে করেছিলেন মোহাম্মদ। মোহাম্মদের নির্দেশে তার কয়েকজন শিষ্য বন্ধুত্বের ছলনার মাধ্যমে কাব বিন আল-আশরাফকে হত্যা করেছিল। সে-রাত ছিল জ্যোৎস্নাপ্লাবিত, আল-আশরাফ তার নববিবাহিত পত্নীকে নিয়ে শুয়ে ছিলেন। তাঁরই পালিত এবং মোহাম্মদের শিষ্য সিলকান বিন সালাম বিন ওয়াকাশ তাকে মাঝরাতে ডেকেছিল, স্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও তিনি বাইরে গিয়েছিলেন। সিলকান ছলনা ক’রে তাকে অন্যত্র নিয়ে যায় এবং অন্য সঙ্গীদের সঙ্গে তাকে হত্যা করে। তারপর তারা আল-আশরাফের ছিন্ন মস্তক ফজরের ওয়াক্তে নিয়ে যায় মসজিদে, মোহাম্মদ তখন নামাজের জন্য দাঁড়িয়েছিলেন, নামাজ আদায় না করেই তিনি বাইরে আসেন, রক্তাক্ত কাটা মস্তকের ওপর থুথু নিক্ষেপ ক’রে শিষ্যদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।
সেই থেকে গত চৌদ্দ’শ বছরে আরবভূমিসহ বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামী রাষ্ট্রে মুসলিমদের দ্বারা নির্যাতিত, নির্বাসিত এবং নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছে অসংখ্য কবি, মুক্তচিন্তক, সমালোচক। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিতা লেখার অপরাধে ১৯৭৪ সালে প্রথম নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন কবি দাউদ হায়দারকে। এরপর প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আমলে ১৯৯৪ সালে নির্বাসিত হয়েছেন তসলিমা নাসরিন। আর মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ে গত ছয়-সাত বছরে অনেকে ইসলামী জঙ্গীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, অনেকে জেল খেটেছেন এবং এখনো জেল খাটছেন, অনেকে আত্মগোপনে আছেন, আর তরুণ লেখকদের একটা বড় অংশ জীবন বাঁচাতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন এবং এখনো জমাচ্ছেন। অথচ কী আশ্চর্য, এই দেশের অধিকাংশ শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক এই হত্যা, নির্যাতন এবং নির্বাসনের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ; তারা ব্যস্ত শাসকের স্তুতিতে! ইসলামী জঙ্গিরা যে দেশে দাপিয়ে বেড়ায়, লেখকের রক্তে যে দেশের রাজপথ ভেসে যায়, সেই দেশেরই শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক এবং সমাজের উচ্চ শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষ নিয়ে গঠিত নাগরিক কমিটি উন্নয়ন ও সুশাসনের উন্নয়নের জননী আখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা প্রদানের আয়োজন করেন, আর সেই তথাকথিত নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে উত্তর প্রজন্মের লেখকের রক্তের ভেতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে শেখ হাসিনাকে ‘দেশরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত ক’রে তার হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন আরেক লেখক সৈয়দ শামসুল হক!
আমি আরেকজন কবির কবরের সামনে এসে ব্যাগ থেকে ফুলের পাপড়ি নিয়ে কবরের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম ক্রমশ ঘনায়মান ছায়া ছায়া অন্ধকারে। স্মৃতিতে জলবিম্বের মতো ভেসে উঠলো কবির কবিতার কিছু পংক্তি। আমি প্রথমে যে কবির কবরের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম তিনি ধার্মিক ছিলেন, আর এখন যে কবির কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি তিনি নাস্তিক ছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, মৃত্যুর পর দু’জনের মৃতদেহই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে প্রথমে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য শহীদ মিনারে রাখা হয়েছিল, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে জানাযা শেষে এখানে কবর দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, প্রথমটি বেশরিয়তী কর্ম এবং পরেরটি শরিয়তী কর্ম; কিন্তু দু’জনের ক্ষেত্রেই এই বিপরীতধর্মী দু'টি কর্ম পর পর সম্পাদন করা হয়েছে। ধার্মিকের কফিনে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন ক’রে যেমনি ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে; তেমনি নাস্তিক কবির লাশের জানাযা পড়ানোয় তার বিশ্বাসকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আজকাল বিজ্ঞ-অজ্ঞ সকলেই মুখে ফ্যানা তুলে ফেলছে একটা কথা বলতে বলতে যে, নাস্তিক ব্লগাররা ইসলামের অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে, তারা ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করছে। কিন্তু কোরান-হাদিসের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যে মৃতের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে, এটা কি ইসলামের অবমাননা নয়? এতে কি মুমিন বান্দাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে না? আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ হাজারো মানুষ মৃতের কবরে বা মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়; শহীদ মিনারে, স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে; নিঃসন্দেহে এসব শরিয়ত বিরোধী কাজ, অনৈসলামিক কাজ। এরা একদিকে বলছে নাস্তিক ব্লগাররা ইসলাম অবমাননা করছে, আবার অন্যদিকে নিজেরাই ইসলাম অবমাননার অনুষ্ঠানে সাড়ম্বরে যোগদান করছে। সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের ধর্ম আছে, ইসলাম ধর্ম। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকেরা রাষ্ট্রের শরীরে বোরখা পরিয়ে দিয়েছে, তারা বাংলাদেশের পাহাড়-সমতলের মাটির প্রতিটি কণাকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে চেয়েছে; গাছপালা, নদী-নালা-খাল-বিল, জীবজন্তু, পশুপখি, জল-বাতাস, বঙ্গোপসাগরকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। অথচ কী আশ্চর্য, এরাই আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে অনৈসলামিক আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে এবং বিধর্মী কাফেরদের সাথে তাতে অংশ নিয়ে প্রতিনিয়ত মোহাম্মদের সহি ইসলামের অবমাননা করছে!
একদিকে রাষ্টের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এইসব ইসলাম বিরোধী কাজ করছে, অন্যদিকে জুম্মার খুতবায় কিংবা ওয়াজ মাহফিলে এইসব বেশরিয়তী কাজকর্মের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে মানুষকে উস্কে দেওয়া হচ্ছে; রাষ্ট্র সেটাও বন্ধ করতে পারছে না। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের মানুষ নিজেদের সুবিধার জন্য নতুন এক জগাখিচুড়ি ধরনের অলিখিত শরিয়তের জন্ম দিয়েছে এবং তা পালন করছে!
কবরে কিংবা শ্মশানে এলেই আজকাল আমার মনে হয়, নাস্তিকদের জন্য আলাদা সমাধিক্ষেত্র প্রয়োজন। ঈশ্বরে অবিশ্বাসী একজন মানুষ সকল প্রকার ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সারা জীবন মুক্তচিন্তা করে, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কথা বলে, ধর্মান্ধতার শৃঙ্খল থেকে মানুষের মুক্তির কথা বলে, সাম্প্রদায়িকতার কথা না ব’লে মানবতার কথা বলে, একটি মাত্র গোষ্ঠীর উন্নতির কথা না ব’লে সমগ্র মানবজাতির উন্নতির কথা বলে। এমন একজন মানুষের মৃত্যুর পর কোনো ধর্মীয় রীতি অনুসরণ ক’রে তার দেহের শেষকৃত্য করা মানে তার সারাজীবনের বিশ্বাস, তার চিন্তা, তার সততা, তার মূল্যবোধ, তার জীবনদর্শন ও আদর্শকে তীব্রভাবে অপমান করা। একজন নাস্তিক জীবদ্দশায় তার মরনোত্তর দেহ দান ক’রে যেতে পারেন, কিন্তু কারো কারো তো এই আশাও থাকতে পারে যে, তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন মাটিতে। কিন্তু যেহেতু নাস্তিকদের জন্য কোনো আলাদা সমাধিক্ষেত্র নেই, তাই তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি মৃত্যু পরবর্তী তার দেহের করণীয় বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দিয়ে যান না, আর তার পরিবারের লোকেরাও সমাজের কথা বিবেচনা ক’রে ধর্মীয় রীতি অনুসরণ ক’রে একজন ধার্মিকের দেহের মতোই তার দেহের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন এবং পরবর্তীতে অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতাও করেন সকল ধর্মীয় রীতি মেনে। এটা একজন মৃত নাস্তিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো নয়, তাকে ভীষণভাবে অসম্মান করা।
সঙ্গত কারণেই নাস্তিকদের জন্য আলাদা একটি সমাধিক্ষেত্র এখন সময়ের দাবি। যদিও পৃথিবীর কোটি কোটি ধার্মিকের ভিড়ে এই চাওয়া পূরণ হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। উন্নত বিশ্বের কোনো কোনো দেশে সম্ভব হলেও আমাদের মতো ইসলামিক রাষ্ট্রে তা কল্পনাতীত। কিন্তু আমার বিশ্বাস, আজ না হোক, বিজ্ঞানের আলো বিস্তৃত আরও হলে, মানুষ আরও সুশিক্ষিত এবং সভ্য হলে এই শতাব্দীতে না হোক, আগামীর কোনো এক শতাব্দীতে পৃথিবীর বুকে একদিন নাস্তিকদের জন্য আলাদা সমাধিক্ষেত্র গড়ে উঠবেই; এমনকি এই ভূ-খণ্ডেও!
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন