লিখেছেন আবুল কাশেম
খাদিজা ও আবু তালিবের মৃত্যুর পর
উইলিয়াম মুর (মুর, পৃঃ ১০৫) লিখেছেন যে, মুহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজা মারা যান ৬১৯ সালে। এর পাঁচ সপ্তাহ পরেই (জানুয়ারি ৬২০) সালে আবু তালেব মারা যান। এই সময়টা ছিল হিজরতের তিন বছর আগে। পরপর এই দুই বিয়োগান্তক ঘটনায় মুহাম্মদ অতিশয় মুষড়ে পড়েন।
এই ব্যাপারে আরও এক প্রখ্যাত জীবনীকার রডিন্সন লিখেছেন:
খাদিজা এবং আবু তালেব মারা যান কয়েকদিনের ব্যবধানে। এই ঘটনা ঘটে ৬১৯ সালে। এরপর থেকে ধারাবাহিক ঘটনাগুলির সন ও তারিখ বেশ নির্ভরযোগ্য ভাবে গণনা করা যেতে পারে। কোন আরবই তার স্ত্রীর বিয়োগের পর বেশীদিন স্ত্রী ছাড়া থাকে না। আর তাছাড়া যার সন্তান আছে তার জন্যে ত কথাই নাই। কিছু দিন, অথবা সর্বোচ্চ কয়েক সপ্তাহ পরেই স্ত্রীহারা মুহাম্মদ সওদা নামে এক বিধবাকে বিবাহ করেন। পূর্বে মুহাম্মদের এক ভক্ত ছিল এই বিধবার স্বামী। সওদা তাঁর স্বামীর সাথে আবিসিনিয়া গিয়েছিলেন। সেখানে সওদার স্বামী খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। সওদা তরুণ বয়সের ছিলেন না এবং বেশ মুটিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সওদা গিন্নি হিসাবে ছিলেন অতি উত্তম। তাই মুহাম্মদের সন্তানদের দেখাশোনার জন্য খুব যোগ্য। এই জন্যই মুহাম্মদ সওদাকে বিবাহ্ করেন। নবীর জীবনে সওদার কোন প্রভাবই ছিল না। নিঃসন্দেহে মুহাম্মদ ছিলেন সওদার প্রভুর মত। সওদা মুহাম্মদকে যৌন তৃপ্তি দিতে সক্ষম ছিলেন না। আর রাজনৈতিক ভাবে নবীর স্থান শক্তিশালী করার জন্য কোন অবদানও সওদার ছিল না। (রডিন্সন, পৃঃ ১৩৪)
মার্টিন লিঙ্গস্ লিখেছেন মৃত্যুকালে খাদিজার বয়স ছিল ৬৫ এবং মুহাম্মদের বয়স প্রায় ৫০। (লিঙ্গস্, পৃঃ ৯৬)
খাদিজার মৃত্যুর পর মুহাম্মদ ঘন ঘন কাবা শরীফে যাওয়া শুরু করলেন আর সেখানে খুব সম্ভবত উচ্চৈঃস্বরে কোরান আবৃত্তি করতেন। আমরা আগেই এক হাদিসে দেখেছি যে, উম হানির গৃহ কাবার এত নিকটে ছিল যে, উম হানি নবীর কোরান আবৃত্তি শুনতে পেতেন। আমরা ধরে নিতে পারি যে, মুহাম্মদ এই সময়ে উম হানির খুব সান্নিধ্যে আসেন—হয়ত বা তিনি নিয়মিত উম হানির গৃহে যাতায়াত করতেন—হয়ত বা অনেক রাত্রি দিন উম হানির গৃহেই কাটাতেন। একবার মুহাম্মদ কোরান আবৃত্তি শেষ করে মাটিতে মাথা ঠেকালেন। এই সময়ই দুষ্ট কিছু কোরায়েশ তাঁর ঘাড়ে ভেড়া (অথবা উটের) নাড়িভুঁড়ি জড়িয়ে দিল। এই সময় মুহাম্মদ স্ত্রীহারা, নিতান্ত একাকী, অসহায়। শত্রু কোরায়েশদের থেকে একটু শান্তি এবং সহানুভূতির জন্য মুহাম্মদ উম হানির দ্বারস্থ হচ্ছিলেন। উম হানিই হয়ে উঠলেন নবীর একমাত্র নারী। উম হানিও সাদরে আপ্যায়ন করলেন নবীকে। তাঁদের দু’জনের বাল্যপ্রেমের দিনগুলি আবার যেন উদ্ভাসিত হয়ে গেল। এই সব কিছুই কোরায়েশদের দৃষ্টি এড়াল না। তারা হয়ত উৎসুক হয়ে উঠল কিসের আনাগোনা মুহাম্মদের উমর হানির গৃহে?
এই পরিস্থিতি এড়াতে মুহাম্মদ বোধকরি চিন্তা করলেন: না, এখানে আর নয়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমাকে যেতে হবে অন্য কোথাও—অন্য কারও কাছে—যারা আমাকে সামান্যভাবে হলেও গ্রহণ করবে, একটু ভক্তি শ্রদ্ধা দেখাবে। এই উদ্দেশ্যে নবী গেলেন তায়েফে। সেখানে থাকত সাকিফ (থাকিফ) লোকেরা। তারা উপাসনা করত দেবী আল লাতের। নবী অনেক চেষ্টা করলেন তাদেরকে ইসলামে দীক্ষিত করতে। কিন্তু তায়েফের লোকেরা তাঁর কথায় কর্ণপাত তো করলই না, বরং তাদের বালকদেরকে লেলিয়ে দিল নবীর পেছনে। এই সব বখাটে রাস্তার বালকেরা নবীকে ঢিল মেরে বাধ্য করল তায়েফ ছাড়তে। মোহভগ্ন, ভারাক্রান্ত, শোকাহত হৃদয়ে মুহাম্মদ আবার ফিরে আসলেন মক্কায়, সেই উম হানির কাছে। একমাত্র উম হানির কাছেই নবী তাঁর মনের কথা খুলে বলতে পারেন।
ইবনে ইসহাক লিখেছেন (পৃঃ ১৯১):
খদিজা এবং আবু তালেব দু’জন একই বৎসরে মারা গেলেন। খদিজার মৃত্যুর সাথেই একের পর এক সমস্যা আসতে লাগল। কারণ খদিজার কাছ থেকেই নবী পেয়েছিলেন ইসলামের সমর্থন। খদিজার কাছে মুহাম্মদ তাঁর সমস্যার কথা আলোচনা করতেন। আবু তালেবের মৃত্যুতে নবী হারালেন তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আর অন্য গোত্রের হামলা থেকে রক্ষার জামিন কবচ। মদিনায় অভিভাষণের বছর তিনেক আগে আবু তালেব মারা যান। এই সময়েই নবী কোরায়েশদের সাথে প্রতিকুল পরিবেশের সম্মূখীন হতে থাকলেন। আবু তালেবের মৃত্যুর পূর্বে নবী কখনই কোরায়েশদের কাছ হতে এমন শত্রুতামূলক ব্যবহার পান নাই।
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন