লিখেছেন পুতুল হক
এখন বাংলা সনের কোন মাস, কতো তারিখ, কিছুই জানি না। এটা জানি একুশে ফেব্রুয়ারির কাছাকাছি আসলে তখন হবে ফাল্গুন মাসের সাত, আট বা নয় তারিখ। আশ্বিন-কার্তিক মাস কি চলে গেছে?
খুব ছোটবেলায় একবার গ্রামে একটা উৎসব দেখেছিলাম, আশ্বিন মাসের শেষ রাতে আর কার্তিক মাসের প্রথম ভোরে। অনেক দুধ দিয়ে ক্ষীর রান্না হয়েছিলো। মেয়েরা সেই শীতের ভোরে হলুদ মেখে গোসল করেছিল, নতুন কাপড় পরেছিল বাড়ির বৌ-ঝি। আমরা পিচ্চিরাও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে আবার ভোরে উঠেছিলাম। অবশ্য গোসল করিনি।
গ্রামের বাড়ি দেখাশোনা করেন যিনি, তাঁকে আমরা ফুপু বলে ডাকি। ফুপুর মেয়ে অঞ্জুর সাথে কথা হচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা এখনো সেসব করে কি না। উত্তরে সে বললো, "আউ সি-সি, ওগুল্যা হিন্দুগে অনুষ্ঠান। মুসলমানগে ওইসব করতি নাই। উয়া করলি পাপ হবি।" শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো।
আমি যখন দেখেছিলাম, মনে আছে নানুমণিরা নামাজ পড়েছিলেন ঠিক সময়ে। কাউকে বলতে শুনিনি এসব হিন্দুরা করে। অঞ্জুকে যখন বললাম যে, তোমার মা, আমার দিদি, এরা কিন্তু করতো। তাঁদের পাপ হয়নি? উত্তরে সে জানালো, "না জেনে করলে পাপ নাই।"
অঞ্জু পাপ-পুণ্য সম্পর্কে তাঁর মা, নানীদের চাইতে অনেক বেশি জানে। আমরা সবাই হয়তো তা-ই। অঞ্জু আগের নিয়মে অনেক কিছু করে না, এখন আবার অনেক নতুন কিছু করে।
গ্রামেগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারের জন্য সরকারকে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়, কিন্তু ধর্মের বিষাক্ত কথাগুলো বাতাসের চাইতে সহজে বিস্তার লাভ করে এমনিতেই। যে জ্ঞান আয়ত্ব করলে মানুষ নিজের স্বাস্থ্য আর পরিবেশের উন্নতি করতে পারে, নিজেদের সমস্যার কারণ বুঝতে পারে, সমাধানের চেষ্টা করতে পারে, নিজের বা পরিবারের জন্য ইতিবাচক কিছু করতে পারে - সেসব শেখার জন্য লোকের হাতেপায়ে ধরতে হয়, কিন্তু পাপপুণ্য শেখার উৎসাহের অভাব নেই।
ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে মানুষ থেকে পৃথক করে। ভালোমন্দ বিচারের ভার যখন অদৃশ্য কোনো শক্তির ওপর ছেড়ে দেয়া, তখন মানুষের নিজস্ব বিবেক পাথরচাপা পড়ে।
নবান্নের অনুষ্ঠান অঞ্জু যদি না-ই বা পালন করে, তাতে কিছু যায় আসে না। পুরনোে অনেক অনুষ্ঠান আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায় অনেক নতুন অনুষ্ঠানের ভিড়ে। কিন্তু নবান্ন পালন না করার সিদ্ধান্তটা এসেছে কিছু মানুষকে অন্য কিছু মানুষ থেকে পৃথক করার জন্য। এখানেই আমার সমস্যা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন