লিখেছেন নরসুন্দর মানুষ
পর্ব ১ > পর্ব ২ > পর্ব ৩ > পর্ব ৪ > পর্ব ৫ > পর্ব ৬ > পর্ব ৭ > পর্ব ৮ > পর্ব ৯ > পর্ব ১০ > পর্ব ১১ > পর্ব ১২ > পর্ব ১৩ > পর্ব ১৪ > পর্ব ১৫
গ্রামে বিচার বসেছে সেলিম-এর চক্রান্ত/প্রতারণা নিয়ে! বিচারপর্বে আমার থাকার সুযোগ হয়নি বটে, তবে কেন জানি না প্রতিবার ফাঁদে পড়তে হয় নিজের ইচ্ছাতেই! হাজী বাড়ির ছেলে হওয়াতে সব বিষয় কানে চলেই আসে! মুরব্বীদের বিচারপর্ব শেষে রাতে খাবার ব্যবস্থা হয়েছে আমাদের বাসাতেই; ৩০-৩৫ জনের খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব পড়েছে আমাদের তিন ভাইয়ের ওপর!
খাবার চলাকালীন এক হুজুর বলছিলেন, "দেখছেন, সেলিম পোলাটা মেয়েটার সাথে কত বড় প্রতারণা করছে, আমার জীবনে এত বড় চক্রান্তকারী, প্রতারণাকারী আর দেখি নাই! এই বেয়াদব পোলার থেকে দো-জাহানে বেশি কেউ চক্রান্ত/প্রতারণা করতে পারে বলে মনে হয় না!"
আমি যে একটা খাটাশ টাইপের প্রাণী, মনেই থাকে না মাঝে মাঝে। কী দরকার ছিলো বলার: "চাচা, আপনার এই কথা মানতে পারলাম না! দো-জাহানের সবচেয়ে বড় চক্রান্তকারী-প্রতারণাকারী হচ্ছেন আল্লাহ্! আপনি সেলিম-কে তার সাথে কিছুতেই তুলনা করতে পারেন না!"
বোঝেন অবস্থা! বাঁশ তুমি ঝাড়ে কেনো, আমার পশ্চাৎদেশ ফাঁকা আছে! আসো! প্রবেশ করো!
সকলে সমস্বরে বলে উঠলেন: নাউজুবিল্লাহ্!
আমি মনে মনে বলিলাম: বাবা হাজীর পোলা, আজ তুমি শেষ!
আব্বা চিৎকার দিয়া ধমক দিলেন! আমি মাথা নিচু করিয়া বলিলাম সুরা ইমরানের ৫৪ নং আয়াতে তাই লেখা আছে!
আর তারা চক্রান্ত/প্রতারণা করেছিল, আর আল্লাহও চক্রান্ত/প্রতারণা করেছিলেন।
আর আল্লাহ চক্রান্ত/প্রতারণা-কারীদের মধ্যে সর্বোত্তম। (সুরা ইমরান-৩:৫৪).
আব্বা আমার দুই ভাইকে পড়ার রুম থেকে বাংলা অনুবাদসহ কোরআন আনতে বললেন; তাহারা মুহিউদ্দীন খান এবং জহুরুল হক-এর অনুবাদ করা কোরআনের দুইটি কপি এনে হাজির! আর আমার পশ্চাৎদেশের আমিনারে-আবদুল্লাহ্! কই, এখানে তো তেমনটা লেখা নেই!
এবং কাফেরেরা চক্রান্ত করেছে আর আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেছেন।
বস্তুতঃ আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোত্তম কুশলী। [মুহিউদ্দীন খান]
আর তারা চক্রান্ত করেছিল, আর আল্লাহ্ও পরিকল্পনা করেছিলেন।
আর আল্লাহ্ পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে সর্বোত্তম। [জহুরুল হক]
আমি বলিলাম, এ দুটো অনুবাদে ভুল আছে; আসল অনুবাদ কী হবে, দেখাতে পারবো। আমাকে ১০ মিনিট সময় দেন! প্রিয় পাঠক: বাসার আরবী-বাংলা-ইংরেজী ডিকশনারীই আমার শেষ ভরসা এখন!
গল্প এবার সংক্ষিপ্ত করি!
আপনারা যারা আরবি পড়তে জানেন না, তাদের জন্য আরবি উচ্চারণটা দিলাম পড়ুন আগে:
(وَمَكَرُواْ وَمَكَرَ اللّهُ وَاللّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ ﴿٥٤
3:54 ‘Wamakaroo wamakaraAllahu waAllahu hayrual-makireena’
৩:৫৪ “ওয়া মাকারূ ওয়ামাকারাল্লাহু ওয়াল্লাহু হাইরুল-মাকারিইন”
এই আয়াতে
‘ওয়া মাকারূ’ অর্থ: আর তারা ‘মাকার’ করে’।
‘ওয়ামাকারাল্লাহু’ অর্থ: আল্লাহও ‘মাকার’ করেন’।
‘ওয়াল্লাহু হাইরুল-মাকারিইন’ অর্থ: আল্লাহ সবচেয়ে ভালো ‘মাকারিইন’।
আয়াতে মূল শব্দ مكر – মাকার যেটি আরবি শব্দ, যার বাংলা আভিধানিক অর্থ: (সম্পূর্ণ নেতিবাচক অর্থে) চক্রান্ত, প্রতারণা, শঠতা, ধূর্ততা, ধোঁকা, কৌশল। ইংরেজিতে Cunning, Wiliness, Deceit, Cheating, Deceive, Guile ইত্যাদি। এই মাকার مكر শব্দের সাথে ‘ঊ’ এবং ‘আ’ ধ্বনি দ্বারা ক্রিয়াপদ গঠিত হয় যেমন শঠতা/ধূর্ততা/কৌশল করে বা করেন। আর ‘মাকারিইন’-এর অধিকতর শঠ বা কৌশলী ওঝাতে ‘হাইরুল মাকারিইন’ ব্যবহৃত হয়। প্রচলিত আরবিতে مكر শব্দটি নেতিবাচক ‘ধোঁকাবাজি/প্রতারণা’ বা Deceit অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইসলাম-বিশ্বাসী অনুবাদকগন আল্লাহর ক্ষেত্রে আসল অর্থ প্রকাশ করতে সংকোচ বোধে কৌশল/কুশলী/পরিকল্পনা/পরিকল্পনাকারী ব্যবহার করেন। ইহাকে সহজ ভাষায় বলতে পারেন “কৃষ্ণ/আল্লাহ করলে কৌশল/পরিকল্পনা, আর আমরা করলে চক্রান্ত/প্রতারণা”, দারুণ বিচার মুমিনদের! ঠিক এরকম বক্তব্য কোরানে পাওয়া যাবে ৭:৯৯, ৮:৩০, ১০:২১, ১৩:৪২, ২৭:৫০ আয়াতেও। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে মুমিনরা কৌশল করে একই বাক্যে অবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে ‘মাকার’ শব্দের অর্থ করেন চক্রান্ত/প্রতারণা কিন্তু বিপরীতে আল্লাহর ক্ষেত্রে সেই একই শব্দ ‘মাকার’ এর অর্থ করেন কৌশল/পরিকল্পনা। কিন্তু এসবের আসল অনুবাদ হবে নিম্নরূপ:
৩:৫৪. আর তারা চক্রান্ত/প্রতারণা করেছিল, আর আল্লাহ্ও চক্রান্ত/প্রতারণা করেছিলেন। আর আল্লাহ্ চক্রান্ত/প্রতারণা-কারীদের মধ্যে সর্বোত্তম।
৭:৯৯. তারা কি আল্লাহর চক্রান্ত/প্রতারণা থেকে নিরাপদ হয়ে গিয়েছে? বস্তুত ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ছাড়া আল্লাহর চক্রান্ত/প্রতারণা থেকে আর কেউ (নিজদেরকে) নিরাপদ মনে করে না।
৮:৩০. স্মরণ কর, সেই সময়ের কথা যখন কাফিরগণ তোমাকে বন্দী করার কিংবা হত্যা করার কিংবা দেশ থেকে বের করে দেয়ার জন্য চক্রান্ত করে। তারা ষড়যন্ত্র করে আর আল্লাহও চক্রান্ত করেন। আল্লাহই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ চক্রান্ত/প্রতারণা-কারী।
১০:২১. আর যখন আমি আস্বাদন করাই স্বীয় রহমত সে কষ্টের পর, যা তাদের ভোগ করতে হয়েছিল, তখনই তারা আমার শক্তিমত্তার মাঝে নানা রকম চক্রান্ত/প্রতারণা তৈরী করতে আরম্ভ করবে। আপনি বলে দিন, আল্লাহ সবচেয়ে দ্রুত চক্রান্ত/প্রতারণা তৈরী করতে পারেন। নিশ্চয়ই আমাদের ফেরেশতারা লিখে রাখে তোমাদের চক্রান্ত/প্রতারণা।
১৩:৪২. ওদের আগে যারা ছিল তারাও চক্রান্ত/প্রতারণা করেছিল, যাবতীয় চক্রান্ত/প্রতারণা আল্লাহর আয়ত্তাধীন। তিনি জানেন প্রত্যেক ব্যক্তি কী কামাই করছে। আর কাফিরগণ অচিরেই জানতে পারবে ভাল পরিণাম কাদের জন্য।
২৭:৫০. তারা এক চক্রান্ত/প্রতারণা করেছিল এবং আমিও এক চক্রান্ত/প্রতারণা করেছিলাম। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি।
কোরআনে এ সকল আয়াতেই পরিষ্কার বলা হয়েছে আল্লাহ সবচাইতে বড় চক্রান্ত/প্রতারণা-কারী, এই হিসাবে ইসলাম ধর্ম চক্রান্ত/প্রতারণা-র ধর্ম!
তো মুমিন বন্ধুগন: দো-জাহানের সবচেয়ে বড় চক্রান্তকারী-প্রতারণাকারী হচ্ছেন আল্লাহ্ এবং আপনি হচ্ছেন তার অনুগত ছোটখাট চক্রান্তকারী-প্রতারণাকারী! চোখ খুলুন, নিজের মস্তিস্ককে প্রশ্ন করুন: আপনি কী হতে চান, মানুষ? না অন্ধ দাস?
(চলবে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন