মূল: খালেদ ওলীদ
অনুবাদ: আবুল কাশেম
[ভূমিকা: ডিসেম্বর মাসে খালেদ ওলিদের ইসলাম পরিত্যাগের জবানবন্দির অনুবাদ করেছিলাম। তখন লিখেছিলাম, খালেদ আমাকে অনেক ই-মেইলে সৌদি আরাবের ইসলাম সম্পর্কে লিখেছিল। এখানে আমি তার আর একটি লেখা অনুবাদ করে দিলাম। উল্লেখযোগ্য যে খালেদের এই লেখাটি একটা বইতে প্রকাশ হয়েছে। বইটার টাইটেল হলো: Why We Left Islam. - আবুল কাশেম, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১০]
আগের পর্ব
দেখুন, এই সৌদি সমাজে আমার ভগিনীরা একেবারেই অসহায় এবং সীমাহীনভাবে পীড়িত। নিজেদের জীবন নিজের হাতে নিয়ে চালাবার কোনো অধিকার তাদের নেই। ওরা সম্পূর্ণভাবে আমার পিতা, আমার ও অন্যান্য ভাইদের ওপর সর্বদা নির্ভরশীল। ওরা কোনোভাবেই একা বাইরে যেতে পারে না। ওদের কেউ ঘরের বাইরে গেলে একজন পুরুষ, যেমন ভাই অথবা পিতাকে নিয়ে যেতে হবে - তার দেহরক্ষী অথবা সহায় হিসেবে। এমনকি দুর্ঘটনা, হাসপাতাল অথবা অন্য কোনো জরুরি অবস্থাতেও ওদের কেউ ঘরের বাইরে পা ফেলতে পারবে না। বিশ্বাস করুন, ওদের কারও হাসপাতাল যাবার প্রয়োজন হলে আমার ভাইকে ডাকতে হবে। তাকে অন্য শহর থেকে আসতে হবে ৩০০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে। সৌদি আরবে মেয়েদের গাড়ি চালানো নিষেধ; আমার বোনেরা গাড়ী চালাতে পারে না, আমার পিতাও গাড়ী চালানো জানেন না। এসব কারণে আমার ভগিনীদের এই সীমাহীন দুর্দশার মাঝে কালাতিপাত করতে হয়। যতই জরুরি বা গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, ওদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য ওদেরকে ওদের মাহ্রামের (আমি, আমার ভাই অথবা পিতা) জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া ওদের কোনো পথ নাই। এদিকে আমার পিতা কেমন করে ব্যাংকের কার্ড (এ টি এম) ব্যবহার করে টাকা তুলতে হয়, তা জানেন না। তাই আমার কোনো ভগিনী টাকা ওঠাতে চাইলে তার কার্ড কোনো অজ্ঞাত লোকের হাতে তুলে দিতে হবে। নিত্যনৈমিত্তিক জিনিস কিনতে চাইলে টাকা কোনো অজানা পুরুষের হাতে দিতে হবে। সেই লোক তখন যা খুশি তাই দাম বলবে। এভাবে সৌদি মেয়েদের দৈনিক অসীম দুর্দশাপূর্ণ অবস্থার মাঝে জীবন কাটাতে হয়। আমি এখানে মাত্র কয়েকটি উদাহরণ দিলাম। আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি আমার নিজের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ওদের সাহায্য করি।
আপনারা হয়তো বলবেন: ওদেরকে সৌদি আরবের বাইরে কোথাও নিয়ে যাও। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ নয়। সৌদি মেয়েদের পাসপোর্ট পেতে হলে ওদের আইনী অভিভাবকের লিখিত অনুমতির প্রয়োজন। শুধু পাসপোর্ট পেলেই হবে না; বিদেশে একা যাবার জন্য মেয়েদের তাদের পিতা অথবা তাদের স্বামীর স্বাক্ষরিত বিশেষ কাগজপত্র জোগাড় করতে হবে। আমি নিশ্চিত যে, একজন নিরক্ষর হিসেবে আমার পিতা কস্মিনকালেও আমার বোনদেরকে বিদেশে পাড়ি দেবার অনুমতি দেবেন না।
মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি, কেন আমাদের সমাজের নারীদেরকে এই সীমাহীন উৎপীড়ন সইতে হচ্ছে। আমার বোনেরা তাদের পিতা অথবা ভাইয়ের অনুমতি ব্যতিরেকে কিছুই করতে পারে না। ওরা সর্বদাই ঘরের ভেতরে আছে, টেলিভিশন দেখছে। ওদের জন্য না আছে কোনো খেলাধুলা, না আছে কোনো কাজ, না আছে কোনো বেঁচে থাকার লক্ষ্য। সত্যি বলতে কি, ওরা বিশ্বের বৃহত্তম জেলে বন্দী আছে - সেই জেলখানা হচ্ছে গোটা সৌদি আরব; আর এই দেশ হচ্ছে খাঁটি, সত্যিকার ইসলামের দেশ।
সুসঙ্গত কারণেই হয়ত অনেকে জানতে চাইবেন - সৌদি নারীদের এই অবর্ণনীয় দুর্দশার হেতু কী; কিসের জন্যে এখানকার নারীরা অকথ্য নির্যাতন সহ্য করে যাচ্ছে? অতি সহজেই আমরা নির্বোধ, যুক্তিহীন, অশিক্ষিত ও সেকেলে সৌদি নিয়ম কানুনকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারি। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারি যে, এসব কিছুরই উৎস হচ্ছে ইসলাম। পরিষ্কারভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এসবের জন্য একমাত্র ইসলাম দায়ী। ইসলামী আইন কানুন আমাদের নারীদেরকে পরিণত করেছে পুরুষদের সম্পত্তিতে। তাদেরকে দাসত্বে ফেলে দিয়েছে এবং নারী হিসেবে তাদের যে মান, সম্ভ্রম, মর্যাদা ও শ্রদ্ধা আছে, তাও হরণ করে নিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, ইসলাম আমাদের নারীদের নারীত্বের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করে তা ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে।
ইসলাম একজন পিতাকে তার কন্যার ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়েছে। পিতা কন্যাকে সর্বতোভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। কন্যাকে যেমনভাবে বিবাহ করানো, তাকে সামাজিক জীবন থেকে সরিয়ে রাখা, এমনকি তাকে মেরে ফেলারও সম্পূর্ণ অধিকার পিতার রয়েছে। আপনারা হয়তো এই জেনে আশ্চর্য হবেন যে, এক সৌদি পিতা যখন খুশি তার কন্যাকে মেরে ফেলতে পারে আইনের তোয়াক্কা না করে। অনুগ্রহপূর্বক জেনে নিন যে, এক সৌদি পিতা তার কন্যাকে মেরে ফেললেও সে পিতা কক্ষনই মৃত্যুদণ্ড পাবে না। এর কারণ হচ্ছে, কন্যা পিতার সম্পত্তি, সে ঐ সম্পত্তি যেভাবে খুশি নিষ্পত্তি করে দিতে পারে - এমনকি মেরে ফেলেও। সৌদি আরবে শরিয়া আইন অনুযায়ী, কোনো পিতা তার কোনো সন্তানকে খুন করলে সরকারের কোনো ক্ষমতা নাই ওই পিতাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা।
ইসলামী আইন অনুযায়ী, পিতার অনুমতি ছাড়া কন্যা বিবাহ করতে পারে না। করলে তা হবে হারাম। সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায় যে, ইসলামে পিতা হচ্ছেন একজন পবিত্র, সাধু পুরুষ - একজন সেনাপতি ও এক বদমেজাজী একনায়ক। এমনকি পিতা অশিক্ষিত, নিরক্ষর, মূঢ়, অনৈতিক, অন্যায়কারী ও সন্তানদের প্রতি অবহেলাপূর্ণ হলেও তার সন্তানদের, বিশেষতঃ কন্যাদের, সেই পিতার বিরুদ্ধে করার কিছুই নেই।
আমি এখন কী করতে পারি?
এই প্রশ্নের সোজা উত্তর হবে - আমার করার কিছুই নেই। এই অবস্থার পরিবর্তন করার কোনো ক্ষমতাই আমার নেই। আমি যদি আমার পিতার বিরুদ্ধে মামলা করি, তবে ইসলামি বিচারক আমার পিতাকে হয়তো প্রশ্ন করবে: আপনি আপনার কন্যাদের বিবাহের ব্যবস্থা করেন না কেন? এর উত্তরে আমার পিতা হয়তো উদাসীনভাবে বলবেন: আমার এই মেয়েগুলো আমার অধীনে আছে; এরা আমার সম্পত্তি। এদের জন্যে আমি যদি সুপাত্র জোগাড় না করি, তবে আল্লাহ্ আমাকে শাস্তি দিবেন। এর প্রমাণ হিসাবে আমার পিতা হয়তো দেখাবেন যেই সব পাত্র তিনি দেখেছেন, তাদের সবাই ধূমপায়ী। তিনি হয়তো সাক্ষী নিয়ে দেখাবেন ঐসব পাত্ররা মসজিদে অনামাযী। এর বিরুদ্ধে ইসলামি বিচারককে নিশ্চুপ থাকতে হবে। বিচারক কোনোক্রমেই আমার পিতাকে সাজা দিতে পারবে না। বরঞ্চ বিচারক আমাকেই সাজা দেবেন, কেননা আমি আমার পিতার সিদ্ধান্ত মানিনি, এবং আমার পিতাকে সম্মান করিনি।
এখন আমি এইরূপ যন্ত্রণা ও হতাশার মাঝে থেকে ধৈর্য ধরে আমার পিতার মৃত্যুর অপেক্ষা করছি। তিনি মারা যাবার পর আমার ভগিনীদের দায়দায়িত্ব আমারই হাতে আসবে। সরকারীভাবে তাদের মালিকানা আমার হাতে ন্যস্ত হবে। আমরা যেমনভাবে গাড়ি, বাড়ি, ছাগল, উট...ইত্যাদির মালিক হই, সেভাবেই আমিও আমার ভগিনীদের মালিক হব। তারপর আমার ইচ্ছামত আমি তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হব। আমি ইচ্ছা করলে তাদেরকে স্বর্গে পাঠাতে পারি অথবা নরকেও।
পাঠকবৃন্দ, অনুগ্রহপূর্বক আমার ভগিনীদের জন্য কোনো দুঃখ প্রকাশ করবেন না, এবং তাদের প্রতি করুণাও করবেন না। আপনারা জেনে একটু তৃপ্তি পাবেন যে, তুলনামূলক ভাবে আমার ভগিনীরা অনেক সৌভাগ্যবতী। কেননা ওরা বছরে একবার অথবা দু’বার শপিং কমপ্লেক্সে বেড়াতে যেতে পারে। ওরা সৌন্দর্যচর্চার জন্য মেক আপ ব্যবহার করতে পারে। এমনকি গান সঙ্গীতও শুনতে পারে। তাদের সবচাইতে বড় স্বাধীনতা হচ্ছে, তারা টেলিভিশনের চ্যানেল পরিবর্তন করতে পারে। কেননা বহু সৌদি নারীদের এই অধিকারটুকুও নেই। আপনাদের কাছে এটা বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য।
জানুয়ারী ২৭, ২০০৬
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন