রবিবার, ১৪ মে, ২০১৭

চিঠি-হুমকি - ৮: হিরাক্লিয়াসের আকুতি ও বানু কুরাইজার আর্তনাদ!: কুরানে বিগ্যান (পর্ব-১৬৯): ত্রাস, হত্যা ও হামলার আদেশ – একশত তেতাল্লিশ

 লিখেছেন গোলাপ

(আগের পর্বগুলোর সূচী এখানে)
"যে মুহাম্মদ (সাঃ) কে জানে সে ইসলাম জানে, যে তাঁকে জানে না সে ইসলাম জানে না।"
স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) চিঠি হুমকিটি পাওয়ার পর রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস মুহাম্মদকে নবী হিসাবে মেনে নিয়ে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নেয়ার জন্য তার সকল সামরিক জেনারেল, উচ্চ-পদস্থ ব্যক্তিবর্গ ও জনগণদের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তা কীভাবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল;  পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের সঙ্গে সুদীর্ঘ ১৮ বছর ব্যাপী (৬১০-৬২৮ খ্রিস্টাব্দ) রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয় অর্জন শেষে সিরিয়া ভূখণ্ড থেকে তাঁর সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল অভিমুখে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে কী কারণে তিনি তার প্রজাদের সমবেত করেছিলেন; সেখানে তিনি তাদের কোন তিনটি প্রস্তাব পেশ করেছিলেন; উপস্থিত জনতা তার সবগুলো প্রস্তাবই কী কারণে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন - ইত্যাদি বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা আগের পর্বে করা হয়েছে। 
প্রশ্ন ছিলো,
"সম্রাট হিরাক্লিয়াস যদি মুহাম্মদের নেতৃত্বে নব্য এই আগ্রাসী ও নৃশংস আরব শক্তির শক্তিমত্তা সম্বন্ধে কোনч পূর্বধারণা না রাখতেন, তবে কেন তিনি মুহাম্মদের ভয়ে ছিলেন এতো ভীত-সন্ত্রস্ত?" 
এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব আমরা খুঁজে পাই বানু কুরাইজা গণহত্যার সময় থেকে শুরু করে মুহাম্মদের এইসব চিঠি-হুমকির সময়কাল পর্যন্ত মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের সংঘটিত অমানুষিক নৃশংস আগ্রাসনের ইতিবৃত্ত  সমসাময়িক পৃথিবীর ঐ অঞ্চলের প্রাসঙ্গিক ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনায়।  The Devil is in the Detail!
>> আদি উৎসের বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় যা আমরা নিশ্চিতরূপে জানি, তা হলো, মুহাম্মদের নৃশংসতা ও আগ্রাসনের প্রথম চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল বদর যুদ্ধের সময়টিতে (পর্ব-৩০-৪৩)! এই যুদ্ধে মুহাম্মদের নেতৃত্বে তাঁর অনুসারীরা ৭০জন কুরাইশকে নৃশংসভাবে করে খুন (পর্ব-৩২), অতঃপর সেই লাশগুলোকে চরম অবমাননায় তারা বদরের এক নোংরা গর্তে একে একে করে নিক্ষেপ (পর্ব-৩৩); ৭০ জন কুরাইশকে করে বন্দী, যাদের দু'জনকে মুহাম্মদের আদেশে বন্দী অবস্থাতেই পথিমধ্যেই করে খুন (পর্ব-৩৫); ৬৮ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় মদিনায়, অতঃপর তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণের বিনিময়ে তাঁদের দেয়া হয় মুক্তি (পর্ব-৩৭)। 
যাদেরকে খুন ও বন্দী করা হয়েছিল, তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন মুহাম্মদ ও তাঁর কোনো না কোনো অনুসারীর একান্ত নিকট-আত্মীয়, পরিবার-পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী বা বন্ধু-বান্ধব!
খন্দক যুদ্ধের পর মুহাম্মদের নৃশংসতা ও আগ্রাসন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে:
>> খন্দক যুদ্ধের পর, বানু কুরাইজা গণহত্যার (পর্ব: ৮৭-৯৫) সময় থেকে খায়বারের জনগণের ওপর মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের অমানুষিক নৃশংসতা (পর্ব: ১৩০-১৫২) ফাদাক আগ্রাসন (পর্ব ১৫৩-১৫৮) শেষে মদিনায় ফিরে আসা পর্যন্ত (মার্চ, ৬২৭ - জুলাই, ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দ) সময়ের ঘটনা ও সমসাময়িক পৃথিবীর ঐ অঞ্চলের দুই পরাক্রমশালী সম্রাট খসরু পারভেজ ও হিরাক্লিয়াসের আঠার বছর ব্যাপী রক্তক্ষয়ী হানাহানির ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ - ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দৃশ্যপটের কালানুক্রমিক পর্যালোচনায় (পর্ব-১৬৪)  আমরা নিম্নবর্ণিত তথ্যগুলো খুঁজে পাই:
মার্চ-এপ্রিল, ৬২৭ সাল (জিলকদ, হিজরি ৫ সাল):
বনি কুরাইজা গণহত্যা (পর্ব: ৮৭-৯৫)! মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে ৬২৭ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে বনি কুরাইজা গোত্রের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের এক এক করে গলা কেটে করা হয় খুন।  তাঁদের মা-বোন-স্ত্রী-কন্যাদের ভাগাভাগি করে করা হয় যৌনদাসীতে রূপান্তর ও ধর্ষণ। তাঁদের অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের করা হয় দাসে পরিবর্তন ও ভাগাভাগি। তাঁদের সমস্ত সম্পত্তি করা হয় লুণ্ঠন এবং পরবর্তীতে এই দাসীদের অনেককে নাজাদ অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে করা হয় বিক্রি ও সেই উপার্জিত অর্থে ক্রয় করা হয় যুদ্ধের জন্য অস্ত্র-শস্ত্র ও ঘোড়া (পর্ব: ৯৩)’। 




আদি উৎসের বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় যে তথ্যটি আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি, তা হলো, বানু কুরাইজা গণহত্যার সময়টিতে তাঁদের গোত্র-নেতা কাব বিন আসাদ অবরুদ্ধ অবস্থায় যখন নিশ্চিতরূপে অনুধাবন করেছিলেন যে, মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা তাঁদেরকে শেষ না করে ফিরে যাবেন না, তখন তিনি তাদের হাত থেকে পরিত্রাণের প্রচেষ্টায় তাঁর লোকদের যে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব পেশ করেছিলেন তা হলো: (পর্ব-৮৮): 
"আমরা এই লোকটিকে সত্য নবী বলে মেনে নিয়ে তার অনুসরণ করবো, কারণ আল্লাহর ইচ্ছায় তোমাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনিই হলেন সেই নবী, যিনি প্রেরিত হয়েছেন, ও তিনিই হলেন সেই ব্যক্তি, যার বিষয় তোমাদের শাস্ত্রে উল্লেখ আছে; তাহলেই তোমাদের জীবন, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানরা রক্ষা পাবে; অথবা এসো, আমরা আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করি, যাতে আমাদের কোনো পিছুটান না থাকে, তারপর আমরা পুরুষরা উন্মুক্ত তরবারি হাতে মুহাম্মদ ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করি, যতক্ষণে না আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মদের মধ্যে ফয়সালা করেন; অথবা, নেমে এসো নিচে, সম্ভবত, আমরা মুহাম্মদ ও তার অনুসারীদের অতর্কিত আক্রমণের মাধ্যমে পরাস্ত করতে পারবো।"
অতঃপর, এই গণহত্যার চার মাস পর থেকে হুদাইবিয়া সন্ধি পূর্ববর্তী সাত মাস সময়ে (জুলাই, ৬২৭ সাল – মার্চ, ৬২৮ সাল [রবিউল আওয়াল – শাওয়াল, হিজরি ৬ সাল]) মুহাম্মদের নির্দেশে তাঁর অনুসারীরা অবিশ্বাসী জনপদের ওপর কমপক্ষে চোদ্দটি আগ্রাসী হামলা চালান (পর্ব-১০৯)!
মুহাম্মদের চিঠি-হুমকিটি পাওয়ার পর আবু সুফিয়ানের সাথে কথাবার্তা সম্পন্ন করার পর হিরাক্লিয়াসের আকুতি প্রস্তাব ছিলো:
"এই ব্যক্তিটি হলো একজন নবী, তাকে আমরা খুঁজে পাই আমাদের গ্রন্থে; --আসুন আমরা মুহাম্মদ-কে অনুসরণ করি, যাতে আমরা নিরাপত্তা পেতে পারি; অথবা প্রতি বছর তার কাছে 'জিযিয়া' কর পৌঁছে দিয়ে, অথবা সম্পূর্ণ সিরিয়া ভূখণ্ড তার কাছে হস্তান্তর করে শান্তি-চুক্তি স্থাপন করি (পর্ব-১৬৮)!" 
অর্থাৎ,
বানু কুরাইজা গোত্র-নেতা কাব বিন আসাদ তাঁদের সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের প্রচেষ্টায় তাঁর জনগণদের উদ্দেশ্যে যে আহ্বান ও প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, হিরাক্লিয়াসের এই আহ্বান ও প্রস্তাব ছিল তারই অনুরূপ। 
আদি উৎসের এই দু'টি বর্ণনায় যে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট, তা হলো, মুহাম্মদের করাল গ্রাসে আক্রান্ত হওয়ার পর বনি কুরাইজা গোত্র নেতা মুহাম্মদ সম্বন্ধে যে অভিমত, আহ্বান ও প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, মুহাম্মদের চিঠি-হুমকি পাওয়ার পর মুহাম্মদ সম্বন্ধে হিরাক্লিয়াসের অভিমত, আহ্বান ও প্রস্তাব ছিল ঠিক তেমনই।
তাঁদের এই প্রতিক্রিয়া যে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের অনাগত আগ্রাসী নৃশংস আক্রমণের বিভীষিকা থেকে তাঁদের জনগণদের বাঁচানোর প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়, তা আদি উৎসের বর্ণনায় অত্যন্ত স্পষ্ট!
ডিসেম্বর, ৬২৭ – জানুয়ারি ৬২৮ সাল (শাবান, হিজরি ৬ সাল):
বানু কুরাইজার গণহত্যার পর কোনোরূপ প্রত্যক্ষ হামলা-আক্রমণে অংশগ্রহণ না করে মুহাম্মদ ছয় মাস কাল মদিনায় অবস্থান করেন। অতঃপর তিনি অবিশ্বাসী জনপদের ওপর আবারও হামলা শুরু করেন, বানু লিহায়েন গোত্রের ওপর হামলার পর বানু আল-মুসতালিক হামলা (পর্ব: ৯৭-১০১)!

অতঃপর মুহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের আক্রমণ করার হুকুম জারি করেন। তারা একযোগে আক্রমণ করে ও তাদের একজন লোকও পালিয়ে যেতে পারে না। তাদের দশ জন লোককে হত্যা করা হয় ও অবশিষ্টদের করা হয় বন্দী। আল্লাহর নবী তাদের পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের ধরে ফেলেন। গবাদি পশু এবং ভেড়াগুলো করা হয় লুট। মুসলমানদের মধ্যে মাত্র একজন মারা যায়। তাদের সিংহনাদ (war cry) ছিল, "ইয়া মানসুর, হত্যা কর, হত্যা করো!" 1 

জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ৬২৮ সাল (রমজান, হিজরি ৬ সাল)

আয়েশার প্রতি অপবাদ (পর্ব: ১০২-১০৭)! বানু আল-মুসতালিক গোত্রের ওপর এই আগ্রাসী নৃশংস হামলাটি (ডিসেম্বর, ৬২৭ – জানুয়ারি ৬২৮ সাল) সম্পন্ন করার পর মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা মদিনায় প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু মদিনায় পৌঁছার পূর্বেই পথিমধ্যে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের অজ্ঞাতেই নবী-পত্নী আয়েশা বিনতে আবু বকর মূল সেনাবাহিনী থেকে একটি রাতের কিয়দংশ থেকে পর দিন দুপুর নাগাদ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। শুরু হয় তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ, যাদের হোতা ছিলেন মিসতাহ বিন উথাথা, হাসান বিন থাবিত ও হামনা বিনতে জাহাশ। প্রায় এক মাস যাবত এই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার পর মুহাম্মদ তাঁর আল্লাহর নামে ওহী নাযিল করে (সূরা নূর, চ্যাপ্টার ২৪) আয়েশাকে নির্দোষ ঘোষণা করেন (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ৬২৮ সাল)! আর, মুখ্য অপবাদকারী হাসান বিন থাবিত- কে দান করেন বারাহ নামক স্থানে বেইরাহ নামের এক ফাঁকা জমি ও শিরিন নামের এক মিশরীয় খ্রিষ্টান দাসী (পর্ব- ১০৭)! 
এই সেই ‘শিরিন’, মুহাম্মদের চিঠি-হুমকিটি পাওয়ার পর যাকে আলেকজান্দ্রিয়ার শাসনকর্তা আল-মুকাওকিস মুহাম্মদের কাছে উপঢৌকন হিসাবে প্রেরণ করেছিলেন! 
আল-তাবারীর বর্ণনামতে মুহাম্মদ আলেকজান্দ্রিয়ার শাসনকর্তা আল-মুকাওকিস, বসরার শাসনকর্তা আল-হারিথ বিন আবি শিমর আল-ঘাসানি, বাইজানটাইন সম্রাট (সিজার) হিরাক্লিয়াস, সাসানিদ (পারস্য) সম্রাট খসরু পারভেজ ও ইথিওপিয়ার শাসনকর্তা, আল-নাদজাসির কাছে চিঠি লিখেছিলেন এপ্রিল-মে, ৬২৮ সালে (হিজরি ৬ সালের জিলহজ মাস), যা প্রেরণ করা হয়েছিল "ছয়জন পত্রবাহকের মাধ্যমে, যাদের তিনজন একসঙ্গে যাত্রা শুরু করে (পর্ব-১৬১)।" 
আল-তাবারীর এই বর্ণনা যদি সত্য হয় তবে মুহাম্মদ কীভাবে আল-মুকাওকিসের কাছে তাঁর চিঠি পাঠানোর তিন মাস আগে, ৬২৮ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে (রমজান, হিজরি ৬ সাল) আয়েশার প্রতি অপবাদকারীকে ‘শিরিন’ নামের এই যৌনদাসী দান করবেন?
তবে কি মুহাম্মদ তাঁর প্রিয় পত্নীর বিরুদ্ধে মুখ্য মিথ্যা অপবাদ আরোপকারী হাসান বিন থাবিত-কে জমি ও যৌনদাসী প্রদানে পুরস্কৃত করেছিলেন আয়েশার ঘটনাটি নিষ্পত্তি হওয়ার অনেক পরে?
কখন? কোথায়?
(চলবে)
তথ্যসূত্র ও পাদটীকা: 

[1] “কিতাব আল-মাগাজি”- লেখক:  আল-ওয়াকিদি (৭৪৮-৮২২ খৃষ্টাব্দ), ed. Marsden Jones, লন্ডন ১৯৬৬; পৃষ্ঠা ৪০৭; ইংরেজি অনুবাদ: Rizwi Faizer, Amal Ismail and Abdul Kader Tayob; ISBN: 978-0-415-86485-5 (pbk); পৃষ্ঠা ১৯৯ http://www.amazon.com/The-Life-Muhammad-Al-Waqidis-al-Maghazi/dp/0415864852#reader_0415864852

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন