সোমবার, ২৪ জুলাই, ২০১৭

চিঠি হুমকি -১০: হিরাক্লিয়াসের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ! কুরানে বিগ্যান (পর্ব-১৭১): ত্রাস, হত্যা ও হামলার আদেশ –একশত পঁয়তাল্লিশ

লিখেছেন গোলাপ

(আগের পর্বগুলোর সূচী এখানে) (ইন্টারন্যাল লিংকে যাতায়াতে কিছুটা সমস্যা হতে পারে: সমাধানের চেষ্টা চলছে; আপাতত প্রক্সি ব্যবহারে লিংকে গমন সহজ হবে)

 
"যে মুহাম্মদ (সাঃ) কে জানে সে ইসলাম জানে, যে তাঁকে জানে না সে ইসলাম জানে না।"
ইসলামের ইতিহাসের আদি উৎসের বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকরা মিশরের সম্রাট আল-মুকাওকিস, পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজ ও আবিসিনিয়ার শাসক আল-নাদজাসির কাছে মুহাম্মদের চিঠির যে সময়কাল উদ্ধৃত করেছেন, তা কী কারণে অসঙ্গতিপূর্ণ; এই চিঠিগুলোর সম্ভাব্য সময়কাল কী ছিলো; কী কারণে মুহাম্মদের এই চিঠিগুলো কখন কোন শাসকের কাছে গিয়ে পৌঁছেছিল তার ইতিবৃত্তের ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কী কারণে তাদের পক্ষে ‘বনি-কুরাইজা গণহত্যার' পরে সংঘটিত মুহাম্মদের আগ্রাসন ও নৃশংসতার ইতিবৃত্ত জানার সুযোগ ছিলো না - ইত্যাদি বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা গত দু'টি পর্বে করা হয়েছে। আদি উৎসে বর্ণিত তথ্য-উপাত্ত ও ঘটনার গভীর বিশ্লেষণে যা স্পষ্ট তা হলো তাদের কাছে প্রেরিত মুহাম্মদের চিঠি-হুমকির সময়কাল ছিল বানু কুরাইজা গণহত্যার পরে বানু আল-মুসতালিক আগ্রাসনের পূর্বে। অন্যদিকে, সম্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে মুহাম্মদের চিঠি হুমকি ও তার প্রতিক্রিয়ার সময়কাল ছিলো অনেক পরে।

হিরাক্লিয়াসের কাছে মুহাম্মদের চিঠি-হুমকি ও তার প্রতিক্রিয়ার সময়কাল:
সম্রাট খসরু পারভেজ ও হিরাক্লিয়াসের আঠার বছর ব্যাপী রক্তক্ষয়ী হানাহানির ৬২৭ সাল - ৬২৮ সালের শেষ দৃশ্যপটের কালানুক্রমিক পর্যালোচনায় আমরা জানতে পারি:

“সম্রাট হিরাক্লিয়াস কর্তৃক দাস্তাগার্ড দখল হওয়ার পর, ৬২৮ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় খসরু পুত্র দ্বিতীয় কাবাদ তার পিতাকে বন্দী করেন ও নিজেকে সাসানিদ সাম্রাজ্যের পরবর্তী শাসক হিসাবে ঘোষণা দেন। --অতঃপর কাবাদ পারস্যের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় বাইজেনটাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পন্ন করেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে বাইজেনটাইনরা পুনরুদ্ধার করে তাদের সকল অঞ্চল, মুক্ত করে তাদের সকল বন্দী সেনাদের, আদায় করে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ ও পুনরুদ্ধার করে তাদের ধর্মীয় 'বিশুদ্ধ ক্রস'। ----পরাজিত সাসানিদরা ৬২৮ সালের শেষ দিকে এনাটোলিয়া থেকে তাদের সৈন্যবাহিনী ফিরিয়ে নেন (পর্ব-১৬৪)।"

অন্যদিকে, আদি উৎসের মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় আমরা জানতে পারি:

“হুদাইবিয়া সন্ধি-চুক্তির পর হিজরি ৬ সালের জিলহজ মাসে (যার শুরু হয়েছিল ১২ই এপ্রিল, ৬২৮ সাল) আল্লাহর নবী ছয়জন লোককে পত্রবাহক-রূপে প্রেরণ করেন। তিনি দিহায়া বিন খালিফা আল-কালবি কে প্রেরণ করেন সিজারের কাছে (পর্ব-১৬১)। ---পারস্যের বিরুদ্ধে এই বিজয় অর্জন ও তাদের কাছ থেকে 'বিশুদ্ধ ক্রস' পুনরুদ্ধার সম্পন্ন করার পর হিরাক্লিয়াস ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও তাকে প্রার্থনা করার নিমিত্তে জেরুজালেমের ('বায়তুল মুকাদ্দাস') উদ্দেশে পদব্রজে রওনা হোন; সেখানে পৌঁছা ও তার প্রার্থনা কর্ম সম্পন্ন করার পর একদা প্রত্যূষে তিনি অস্থির অবস্থায় ঘুম থেকে জেগে ওঠে ঘোষণা দেন যে তিনি গত রাতে এক স্বপ্ন দেখে জানতে পেরেছেন, লিঙ্গাগ্রচর্মছেদন প্রথা পালনকারী রাজ্য হবে বিজয়ী (পর্ব-১৬৫)! প্রত্যুষে যখন তিনি তার পরিষদবর্গের সাথে এ বিষয়ে আলাপ আলোচনা করছিলেন, তখন তার কাছে পাঠানো মুহাম্মদের চিঠি-টি মদিনা থেকে বসরার শাসনকর্তার হাত ঘুরে জেরুজালেমে তার কাছে এসে পৌঁছে। অতঃপর তিনি আবু-সুফিয়ান-কে তার দরবারে তলব করেন ও অল্প কিছু প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে নিশ্চিত হোন যে 'এই মুহাম্মদই হলো তাদের গ্রন্থে বর্ণিত নবী’; তিনি তার সেই অভিমত দরবারে উপস্থিত লোকদের মেনে নেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু তারা তার প্রস্তাবে ভীষণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন (পর্ব: ১৬৬)।

অতঃপর তিনি তার সেই অভিমত জানিয়ে সিরিয়া থেকে রোমে তার এক বন্ধুর কাছে চিঠি লিখেন! বন্ধুটি তার চিঠি পাওয়ার পর তাকে লিখে জানান যে 'কথা সত্য!'; অতঃপর তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় তার সকল উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের তার দরবারে ডেকে নিয়ে এসে যখন তার সেই অভিমত আবারও ব্যক্ত করেন, তখন তাদের প্রত্যেকে আবারও ভীষণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন (পর্ব-১৬৭)! ----"


আদি উৎসের মুসলিম ঐতিহাসিকরা এই উপাখ্যানের বর্ণনায় যে তথ্যগুলো উদ্ধৃত করেছেন, তার আলোকে এই উপাখ্যানের সকল ঘটনার সম্ভাব্য সময়কাল নির্ধারণ করা যায়:

বর্ণিত হয়েছে:
"হুদাইবিয়া সন্ধি-চুক্তির পর হিজরি ৬ সালের জিলহজ মাসে (এপ্রিল-মে, ৬২৮ সাল) হিরাক্লিয়াসের কাছে লেখা চিঠিটি মুহাম্মদ তাঁর এক পত্রবাহক মারফত মদিনা থেকে বসরা শাসনকর্তার কাছে লিখে পাঠান। অতঃপর বসরার শাসনকর্তা এক পত্রবাহক মারফত সেই চিঠিটি বসরা থেকে জেরুজালেমে হিরাক্লিয়াসের কাছে পৌঁছে দেন।"

স্থলপথে মদিনা থেকে বসরার (ইরাক) দূরত্ব হলো প্রায় ৭৭০ মাইল। যাত্রা পথে কোনরূপ অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণ না করে, প্রতি দিন গড়ে ৩০ মাইল বেগে পদব্রজে বা স্বল্প-ভারবাহী উটের পিঠে চেপে মদিনা থেকে বসরার এই দূরত্ব পাড়ি দিতে পত্রবাহকের সময় লাগবে কমপক্ষে ২৬দিন। আর বসরা থেকে জেরুজালেমের স্থলপথ দূরত্ব হলো আরও ১০০০ মাইল। মরু পথের এই দূরত্ব পাড়ি দিতে পত্রবাহকের সময় লাগবে কমপক্ষে আরও ৩৪দিন। অর্থাৎ, যাত্রা পথের মোট সময় কমপক্ষে = ২৬ +৩৪ দিন = ৬০ দিন বা দুই মাস। পত্রবাহক মদিনা থেকে বসরা ও বসরা থেকে জেরুজালেমের এই দুই মাস যাত্রাপথে কোনরূপ অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণ করেন নাই, এবং/অথবা বসরার শাসনকর্তা মুহাম্মদের চিঠি পাওয়ার পর তা হিরাক্লিয়াসের কাছে পাঠানোর পূর্ব পর্যন্ত কোনরূপ অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণ করেন নাই, এমন প্রস্তাব বাস্তব সম্মত নয়। তারা যে সম্ভাব্য অতিরিক্ত সময়টুকু ক্ষেপণ করেছিলেন, তা এই ৬০ দিন সময়ের সাথে যুক্ত করে আমরা 'মুহাম্মদ-হিরাক্লিয়াস' চিঠি প্রক্রিয়ার মোট সময় নির্ধারণ করতে পারি; যা হতে পারে কমপক্ষে আড়াই মাস।

অর্থাৎ, আদি উৎসের বর্ণনা মতে মুহাম্মদ যদি হুদাইবিয়া সন্ধি-চুক্তির (এপ্রিল-মে, ৬২৮ সাল) অব্যবহিত পরেই হিরাক্লিয়াসের কাছে চিঠি পাঠান তবে সেই চিঠিটি হিরাক্লিয়াসের কাছে কাছে গিয়ে পৌঁছেছিল মুহাম্মদের খায়বার, ফাদাক ও ওয়াদি আল-কুরার অমানুষিক নৃশংসতার (জুলাই, ৬২৮ সাল) কমপক্ষে এক মাস পর, ও হুদাইবিয়া সন্ধি-চুক্তির কমপক্ষে আড়াই মাস পর।

প্রশ্ন হলো,
"আদি উৎসের এই বর্ণনা কী 'হিরাক্লিয়াস-আবু সুফিয়ান' উপাখ্যানের বর্ণনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ?"

স্থলপথে মক্কা থেকে সিরিয়ার দূরত্ব হলো ১২৩০ মাইল। কাফেলা বাণিজ্য বহনকারী উটের সর্বোচ্চ গতি প্রতি দিনে ১৮-২৫ মাইল, গড়ে প্রতিদিন ২০ মাইলের বেশী নয়। হুদাইবিয়া সন্ধি-চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ("তারা আগামী দশ বছর যুদ্ধ বন্ধ রাখবে যাতে জনগণ সহিংসতা পরিহার করে নিরাপদে থাকতে পারে [পর্ব-১২৮]") তাঁরা নির্ভয়ে বাণিজ্য-কর্ম করতে পারবেন' এই ভরসায় যদি আবু-সুফিয়ান ও তাঁর সঙ্গীরা হুদাইবিয়া সন্ধি-চুক্তির পর পরই মক্কা থেকে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হোন, তবে যাত্রাপথে কোনরূপ অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণ না করে মরুভূমির এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে আবু-সুফিয়ান ও তাঁর দলের সময় লাগবে কমপক্ষে ৬২ দিন। মরুভূমির এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আবু সুফিয়ান ও তার সঙ্গীরা কোনরূপ অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণ করেন নাই, এমন প্রস্তাব অবাস্তব। তাঁরা যে সম্ভাব্য অতিরিক্ত সময়টুকু ক্ষেপণ করেছিলেন, তা এই ৬২ দিন সময়ের সাথে যুক্ত করে তাঁদের এই যাত্রার সম্ভাব্য মোট সময়কাল নির্ধারণ করা যায়। যৌক্তিকভাবেই তা হতে পারে কমপক্ষে আড়াই মাস। অর্থাৎ, আবু-সুফিয়ান ও তাঁর সঙ্গীরা যদি হুদাইবিয়া সন্ধি-চুক্তির পর পরই মক্কা থেকে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হোন, তবে তাঁরা মুহাম্মদের চিঠি-টি হিরাক্লিয়াসের কাছে পৌঁছার সময়টিতে সিরিয়ায় অবস্থান করছিলেন।

এই হিসাবে, হুদাইবিয়া সন্ধি-চুক্তির সময়কালে মুহাম্মদ হিরাক্লিয়াসের কাছে চিঠি লিখেছিলেন ও আবু সুফিয়ান বাণিজ্য উপলক্ষে সিরিয়ায় অবস্থান করার সময়টিতে সেই চিঠিটি হিরাক্লিয়াসের কাছে গিয়ে পৌঁছেছিল’ বর্ণনাটি সঙ্গতিপূর্ণ।

>> মুহাম্মদের চিঠি হুমকি পাওয়ার পূর্বে হিরাক্লিয়াস মুহাম্মদের আগ্রাসন ও ‘বনি-কুরাইজা গণহত্যা’ পরবর্তী একের পর এক উপর্যুপরি বিজয় অর্জনের কোন খোঁজখবর রাখতেন কী না তা জানা সম্ভব নয়। কিন্তু মুহাম্মদের চিঠি হুমকিটি পাওয়ার পর হিরাক্লিয়াস কী পরিমাণ উদ্বিগ্নচিত্ত ছিলেন তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় আদি উৎসের বর্ণনায়!

বর্ণিত হয়েছে:
‘অতঃপর হিরাক্লিয়াস তার পুলিশ-প্রধানকে ডেকে পাঠান ও তাকে বলেন, "আমার জন্য তুমি সিরিয়া তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকো, যতক্ষণে না তুমি এই লোকটির এলাকার কোনও লোককে আমার কাছে হাজির করতে পারো (পর্ব-১৬৬)! --------অতঃপর হিরাক্লিয়াস মুহাম্মদের ব্যাপারে তার অভিমত যথার্থ কিনা তা জানার অভিপ্রায়ে সিরিয়া থেকে রোমে তার এক বন্ধুর কাছ চিঠি লেখেন [পর্ব-১৬৭]। প্রতি উত্তরে বন্ধুটি হিরাক্লিয়াসের কাছে চিঠি লিখে জানান যে মুহাম্মদ সত্যই আল্লাহর নবী!’

স্থলপথে সিরিয়া থেকে মদিনার দূরত্ব হলো ১০০০ মাইল। যাত্রা পথে কোনরূপ অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণ না করে, প্রতি দিন গড়ে ৩০ মাইল বেগে পদব্রজে বা স্বল্প-ভারবাহী উটের পিঠে চেপে এই দূরত্ব পাড়ি দিয়ে হিরাক্লিয়াসের নিযুক্ত কোন লোকের সিরিয়া থেকে মদিনায় গিয়ে মুহাম্মদের যাবতীয় নাড়ি-নক্ষত্র ও তাঁর হালনাগাদ কর্ম-কাণ্ড ও শক্তিমত্তার সমস্ত খবরাখবর নিয়ে সিরিয়ায় প্রত্যাবর্তন করতে পথে তার মোট সময় ব্যয় হবে ৩৪ দিন + ৩৪ দিন = ৬৮ দিন (প্রায় আড়াই মাস)। অন্যদিকে, স্থলপথে সিরিয়া থেকে রোমের দূরত্ব হলো ২৩০০ মাইল, যা অতিক্রম করতে, ওপরে বর্ণিত হিসাবে, পত্রবাহকের সময় লাগবে কমপক্ষে ৭৭ দিন। অতঃপর সেখান থেকে চিঠিটির জবাব নিয়ে সিরিয়ায় প্রত্যাবর্তন করতে তার সময় লাগবে আরও ৭৭ দিন। মোট ১৫৪ দিন (প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস)। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় পত্রবাহক কোনরূপ অতিরিক্ত সময় ক্ষেপণ করেন নাই, এমন প্রস্তাব অবাস্তব। সুতরাং, যা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তা হলো, হিরাক্লিয়াস তার বন্ধুর কাছে এই চিঠি আদান-প্রদান প্রক্রিয়ায় কমপক্ষে ছয় মাস সময় অপেক্ষা করার পর ৬২৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, কিংবা তারও পরের কোন এক সময়ে তার ঐ চিঠিটির জবাব পেয়েছিলেন!

বর্ণিত হয়েছে:
"হিরাক্লিয়াস তার সেই চিঠির জবাব পাওয়ার পর রোমান জনগণদের সমবেত করে মুহাম্মদের প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য তাদের-কে আবারও আহ্বান জানান! কিন্তু তার সেই চেষ্টা আবারও ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হওয়ার পর তিনি সিরিয়া থেকে তার সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল প্রত্যাবর্তন করেন ['হিরাক্লিয়াসের শেষ প্রস্তাব (পর্ব-১৬৮)]'!"

প্রশ্ন হলো:
“অপেক্ষার এই দীর্ঘ সময়টিতে উদ্বিগ্ন হিরাক্লিয়াস কী তার কোন নিজস্ব লোককে মদিনায় পাঠিয়ে মুহাম্মদের কর্ম-কাণ্ডের ইতিবৃত্ত জানার চেষ্টা করছিলেন? না কী এই সময়টিতে তিনি তার কোন কিছুই না করে নিশ্চিন্তে বসে বসে 'শুধু' তার চিঠির জবাবের অপেক্ষা করছিলেন?"

কোন ‘চিঠি হুমকি’ পাওয়ার পর যদি তা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ (serious threat) বলে বিবেচিত হয়, তবে যে কোন সাধারণ ব্যক্তিই বিভিন্ন উপায়ে এই হুমকি প্রদানকারী ব্যক্তি বা গুষ্টির ব্যাপারে যথা সম্ভব খবরাখবর সংগ্রহের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। তিনি তাদের ব্যাপারে' সমস্ত খবরাখবর আহরণের প্রচেষ্টায় তার সাধ্যের সবটুকুই কাজে লাগান। আক্রান্ত ব্যক্তির এটি এক স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এমত পরিস্থিতিতে কোন ব্যক্তিই শুধুমাত্র তার এলাকায় বাণিজ্য কর্মে আগত পূর্ব পরিচয়-হীন অজানা কোন ব্যবসায়ীর 'বক্তব্য-কে মহাসত্য' বলে অভিমত দিয়ে নিশ্চিন্ত-চিন্তে মাসের পর মাস সময় অতিবাহিত করেন না!
হিরাক্লিয়াসের বিবেচনায় মুহাম্মদের এই চিঠি হুমকি-টি যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার নিশ্চিত প্রমাণ হলো:

“মুহাম্মদের চিঠি হুমকি পাওয়ার পর হিরাক্লিয়াস উদ্বিগ্নচিত্তে আবু-সুফিয়ান ও তাঁর সঙ্গীদের দরবারে ধরে নিয়ে এসে মুহাম্মদের ব্যাপারে খোঁজ খবর করেছিলেন!”

আবু সুফিয়ানের সাথে অল্প কিছু কথাবার্তা ও অর্থহীন সামান্য কিছু প্রশ্ন ও তার জবাব জানার পর (পর্ব-১৬৬) হিরাক্লিয়াস শুধুমাত্র তার অভিমতের সত্যতা প্রমাণের চেষ্টায় ছয় মাস সময় ব্যয় করেছিলেন, কিন্তু তিনি এই দীর্ঘ সময় অপেক্ষা কালে মাত্র আড়াই মাস পথ পাড়ি দিয়ে ‘খসরু পারভেজের মত (পর্ব-১৬৩)’ তার নিজস্ব লোকদের মদিনায় পাঠিয়ে মুহাম্মদের কর্ম-কাণ্ডের ইতিবৃত্ত জানার কোন চেষ্টায় করেন নাই, এমন দাবী সত্য হলে তা নিশ্চিতরূপেই হিরাক্লিয়াস-কে এক অদূরদর্শী, জড়বুদ্ধি ও আহাম্মক ব্যক্তিরূপে চিহ্নিত করে - যা  নিশ্চিতরূপেই অযৌক্তিক, অবাস্তব ও উদ্ভট!  সম্রাট হিরাক্লিয়াস কোন অদূরদর্শী, জড়বুদ্ধি, আহাম্মক অথবা এমন কি কোন সাধারণ ব্যক্তি ও ছিলেন না; তিনি ছিলেন জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও বহুবছর ব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্রহে অভিজ্ঞ বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের সর্বাধিনায়ক!
সংক্ষেপে,
আদি উৎসের মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনা ও সমসাময়িক ইতিহাসের তথ্য উপাত্তের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে যা প্রায় নিশ্চিতরূপেই প্রতীয়মান হয় তা হলো: 
(১) আল-মুকাওকিস, খসরু পারভেজ ও আল-নাদজাসির কাছে প্রেরিত মুহাম্মদের চিঠি-হুমকির সম্ভাব্য সময়কাল ছিল বানু কুরাইজা গণহত্যার পরে এবং বানু আল-মুসতালিক, বানু ফাযারাহ ও উম্মে কিরফা হত্যাকাণ্ড [পর্ব-১১০], খায়বার, ফাদাক - ইত্যাদি আগ্রাসন ও নৃশংসতার আগে। অন্যদিকে, হিরাক্লিয়াসের কাছে মুহাম্মদের চিঠি-হুমকি ও তার প্রতিক্রিয়ার সময়কাল ছিলো মুহাম্মদের এই সব নৃশংস আগ্রাসনের পরে। সময়ের এই ব্যবধানের কারণে মুহাম্মদের চিঠি হুমকি প্রতিক্রিয়ার সময়টি-তে হিরাক্লিয়াসের পক্ষে মুহাম্মদের হালনাগাদ কার্যকলাপের ইতিবৃত্ত জানার সুযোগ ছিলো, কিন্তু অন্যান্য শাসকদের জন্য তা ছিলো অসম্ভব। 
(২) মুহাম্মদের চিঠি হুমকি পাওয়ার পর হিরাক্লিয়াস দীর্ঘ ছয় মাসেরও অধিক কাল বিভিন্ন উৎস থেকে মুহাম্মদের কর্ম-কাণ্ডের ইতিবৃত্ত জানার চেষ্টা করেছিলেন মুহাম্মদের সকল আগ্রাসনের ইতিবৃত্ত ও শক্তিমত্তার সর্বশেষ পরিচয় হিরাক্লিয়াস নিশ্চিত জানতেন।

(৩) পারস্য সম্রাটের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আঠার বছর ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হিরাক্লিয়াস বিজয়ী হয়েও পরাজিত হয়েছিলেন এই বিবেচনায় যে, তিনি এই যুদ্ধে তার প্রায় সমস্ত শক্তি ব্যয় করেছিলেন। এমত অবস্থায় তিনি মুহাম্মদের নেতৃত্বে ধর্মের নামে উদীয়মান আগ্রাসী আরব শক্তির বিরুদ্ধে কোনরূপ ঝামেলায় জড়াতে চান নাই।

(৪) হিরাক্লিয়াস নিশ্চিত জানতেন, “মুহাম্মদের আগ্রাসী আক্রমণ থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো 'তাঁর বশ্যতা স্বীকার করা!' হিরাক্লিয়াস সেই চেষ্টায় করেছিলেন! সে কারণেই আক্রান্ত অবস্থায় বনি কুরাইজা গোত্র নেতা কাব বিন আসাদ মুহাম্মদ সম্বন্ধে যে অভিমত, আহ্বান ও প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, মুহাম্মদের চিঠি হুমকি পাওয়ার পর তার অভিমত, আহ্বান ও প্রস্তাব ছিল ঠিক তেমনই (পর্ব-১৬৯)হিরাক্লিয়াস যে কোন শর্তে মুহাম্মদের সাথে আপোষ রফায় রাজী ছিলেন সে কারণেই!

(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন