শুক্রবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৭

নবী মুহাম্মদের 'ওমরাহ' ও কুরাইশদের সহিষ্ণুতা! কুরানে বিগ্যান (পর্ব-১৭৪): ত্রাস, হত্যা ও হামলার আদেশ –একশত আটচল্লিশ

লিখেছেন গোলাপ

(আগের পর্বগুলোর সূচী এখানে) (ইন্টারন্যাল লিংকে যাতায়াতে কিছুটা সমস্যা হতে পারে: সমাধানের চেষ্টা চলছে; আপাতত প্রক্সি ব্যবহারে লিংকে গমন সহজ হবে)
 
"যে মুহাম্মদ (সাঃ) কে জানে সে ইসলাম জানে, যে তাঁকে জানে না সে ইসলাম জানে না।"


স্বঘোষিত আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর মদিনা অবস্থানকালীন সময়ে দামেস্কের শাসনকর্তা আল মুনধির বিন আল-হারিথ বিন আবি শিমর আল-ঘাসানি, পারস্যের সম্রাট খসরু পারভেজ দ্বিতীয়, বাইজেনটাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও আবিসিনিয়ার শাসনকর্তা আল-নাজ্জাসীর কাছে যে চিঠিগুলো লিখেছিলেন তার বিস্তারিত আলোচনা ও পর্যালোচনা গত তেরটি পর্বে (পর্ব: ১৬১-১৭৩) করা হয়েছে। মুহাম্মদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ নবী পত্নী উম্মে হাবিবা (রামলাহ) বিনতে আবু সুফিয়ান কী কারণে তার জন্মদাতা পিতা-কে '‘অপবিত্র" আখ্যা দিয়ে তাঁর প্রতি চরম অবমাননা ও অসম্মান প্রদর্শন করেছিলেন, তার বিস্তারিত আলোচনা আগের পর্বে করা হয়েছে।



মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা খায়বারের অমানুষিক নৃশংসতা (পর্ব: ১৩০-১৫২), ফাদাক আগ্রাসন (পর্ব: ১৫৩-১৫৮) ও ওয়াদি আল-কুরা আগ্রাসন শেষে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন হিজরি ৭ সালের সফর মাসে। অতঃপর রবিউল আওয়াল মাস থেকে শওয়াল মাস (৯ই জুলাই ৬২৮ সাল থেকে ১লা মার্চ ৬২৯ সাল) পর্যন্ত পরবর্তী আট-টি মাস মুহাম্মদ আর কোন হামলায় নিজে অংশগ্রহণ না করে মদিনায় অবস্থান করেন। আর কোন হামলায় নিজে অংশগ্রহণ না করলেও অবিশ্বাসী জনপদের ওপর তাঁর আগ্রাসী হামলা তিনি কখনোই বন্ধ করেন নাই। আদি উৎসের বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় আমরা জানতে পারি, এই সময়টিতে তিনি তাঁর অনুসারীদের মাধ্যমে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অবিশ্বাসী জনপদের ওপর কমপক্ষে আরও ছয়টি আগ্রাসী হামলা পরিচালনা করেন, যার দু'টির আলোচনা ইতিমধ্যেই করা হয়েছে (পর্ব-১৬০)। এই হামলাগুলো ছাড়াও আবু বসির নামের তাঁর এক অনুসারীর নেতৃত্বে কুরাইশ বাণিজ্য-বহরের ওপর হামলা, খুন-জখম ও মালামাল-লুণ্ঠন ছিল পুরো-দমে অব্যাহত।
অতঃপর, হিজরি ৭ সালের জিলকদ মাসে তিনি তাঁর সাথে ঠিক এক বছর আগে হুদাইবিয়া যাত্রায় অংশগ্রহণকারী সকল জীবিত অনুসারী ও আরও কিছু অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে 'ওমরাহ' পালনের নিমিত্তে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। মদিনায় স্বেচ্ছা নির্বাসনের পর এটিই ছিল মুহাম্মদের প্রথম ও শেষ 'সফল’ ওমরাহ পালন! আদি উৎসের মুসলিম ঐতিহাসিকরা মুহাম্মদের এই ঐতিহাসিক ওমরাহ পালনের বর্ণনা তাঁদের নিজ নিজ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। সবচেয়ে বিস্তারিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন আল-ওয়াকিদি, তাঁর 'কিতাব আল-মাগাজি' গ্রন্থে। ইবনে হিশাম মুহাম্মদের এই তীর্থযাত্রা-কে 'প্রতিশোধের ওমরাহ (Lesser Pilgrimage of Retaliation)’, আল-তাবারী এটিকে 'পূর্ণাঙ্গ ওমরাহ যাত্রা (Lesser Pilgrimage of Fulfillment)', আর আল-ওয়াকিদি এটিকে 'আল-কাদিয়ার ওমরাহ (Umrat al-Qaḍiyya)' নামে আখ্যায়িত করেছেন। আল-ওয়াকিদির বর্ণনা মতে এই ওমরাহ যাত্রায় তাঁর অনুসারীর মোট সংখ্যা ছিল প্রায় দুই হাজার। এই ওমরাহ পালন শেষে মুহাম্মদ মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন হিজরি ৭ সালের জিলহজ মাসে। অতঃপর ঐ মাসেই তিনি অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যে হামলাকারী দল-টি পাঠান, তা হলো, "ইবনে আবি আল-আওজা আল-সুলামির অধীনে ‘বানু সুলায়েম হামলা (পর্ব-১২৪)’!"


এই ঘটনার ঠিক এক বছর আগে হিজরি ৬ সালের জিলকদ মাসে (মার্চ-এপ্রিল ৬২৮ সাল) মুহাম্মদ যে ওমরাহ যাত্রায় রওনা হয়েছিলেন, তা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি কুরাইশদের সঙ্গে 'হুদাইবিয়া সন্ধি চুক্তি' স্বাক্ষর শেষে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর তিনি কমপক্ষে তিনবার হুদাইবিয়া সন্ধি-চুক্তির প্রায় প্রত্যেক-টি শর্ত ভঙ্গ করেছিলেন, যার বিস্তারিত আলোচনা ও পর্যালোচনা চুক্তি ভঙ্গ এক (পর্ব-১২৫), চুক্তি ভঙ্গ তিন (পর্ব-১২৭) চুক্তি ভঙ্গ চার (পর্ব-১২৮) পর্বে করা হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসের এমনই এক প্রেক্ষাপটে মুহাম্মদের এই ঐতিহাসিক ওমরাহ যাত্রা! এত কিছুর পরেও কী কুরাইশরা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের প্রতি কোনরূপ অন্যায়-অবিচার করেছিলেন? তাদের প্রতি কুরাইশদের মনোভাব কেমন ছিল?

মুহাম্মদ ইবনে ইশাকের (৭০৪-৭৬৮ সাল) বর্ণনা: [1] [2] [3]

'খায়বার থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তনের পর আল্লাহর নবী রবিউল আওয়াল মাস থেকে শওয়াল মাস পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন ও এই সময়টিতে তিনি একাধিক অভিযান ও হামলাকারী দল প্রেরণ করেন। অতঃপর জিলকদ মাসে [যার শুরু হয়েছিল মার্চ ২, ৬২৯ সাল], আগের বছর যে মাসটি-তে মুশরিকরা তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন [পর্ব-১১১], তিনি তাদের সেই ফিরিয়ে দেয়া ওমরা হজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে রওনা হন। [4] তাঁর সঙ্গে যাত্রাকারী যে মুসলমানদের বাধা প্রদান করা হয়েছিল, হিজরি ৭ সালে তারা তাঁর সঙ্গে যাত্রা করে; যখন মক্কাবাসীরা এই খবর-টি শুনতে পায়, তারা তাঁর পথ থেকে চলে যায়। কুরাইশরা তাদের নিজেদের মধ্যে এই বলে বলাবলি করে, “মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীরা দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিত।

এমন একজন লোক যাকে আমার সন্দেহ করার কোন কারণ নেই,  আমাকে বলেছেন যে ইবনে আব্বাস বলেছেন: 'তারা তাঁকে ও তাঁর অনুসারীদের দেখতে তাদের সম্মেলন কক্ষের (Assembly house) দরজায় এসে সমবেত হয়। যখন আল্লাহর নবী মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করেন, তিনি তাঁর আলখাল্লার শেষ প্রান্তটি তাঁর বাম কাঁধের ওপর ছুড়ে দিয়ে তাঁর ডান বাহুর ওপরের অংশ উন্মুক্ত রাখেন। অতঃপর তিনি বলেন, "সেই লোকটির ওপর আল্লাহর করুণা, যে আজ তাদের-কে তার শক্তি  প্রদর্শন করাচ্ছে।” অতঃপর তিনি পাথর-টি তে চুমু খান ও দ্রুত পায়ে হেঁটে বাহিরে চলে আসেন, তাঁর অনুসারীরাও তাই করে যতক্ষণে না উপাসনালয়-টি তাঁকে লোকজনদের কাছ থেকে আড়াল করে। অতঃপর তিনি দক্ষিণ কোণে চুমু খান (আল তাবারী: 'স্পর্শ করেন') ও কাল পাথরে চুমু খাওয়ার ('স্পর্শ করার') জন্য হেঁটে যান। অতঃপর তিনি একইভাবে দ্রুত পায়ে হেঁটে তিনবার তা প্রদক্ষিণ করেন ও পরের অংশটি হেঁটে পার হোন। ইবনে আব্বাস যা বলতেন তা হলো, "লোকেরা মনে করেছিল যে এই রীতিটি তাদের জন্য অবশ্যপালনীয় নয়; কারণ আল্লাহর নবী এটি করেছিলেন শুধুমাত্র কুরাইশ বংশের জন্যে, এ জন্যে যে তিনি তাদের সম্বন্ধে এমনটিই শুনেছিলেন। কিন্তু যখন তিনি বিদায় হজের দিনে এই রীতি-টি অনুসরণ করেন, তখন থেকে তা 'সুন্নত' হিসাবে পালিত হয়।"’

আবদুল্লাহ বিন আবু বকর আমাকে বলেছেন যে যখন আল্লাহর নবী ঐ তীর্থযাত্রায় সময় মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা (Abdullah b. Rawaha) তাঁর উটের গলার দড়িটি ধরে ছিলেন ও বলছিলেন:

‘তার পথ থেকে সরে যা, 'অবিশ্বাসী তোরা, পরিষ্কার কর পথ
যা কিছু ভাল জিনিস তা আছে মোর রসুলের সাথে
হে প্রভু, আমি বিশ্বাস করি তার বানী
আমি তা গ্রহণ করে আল্লাহর সত্যতার খবর জানি
মোরা যুদ্ধ করবো তোদের সাথে তার ব্যাখ্যা মতে।
যেমন যুদ্ধ তোদের সাথে করেছিনু মোরা তা নাজিলের প্রাক্কালে।
আঘাতে আঘাতে হবে তোদের গর্দান স্কন্ধ চ্যুত
আরও যা করবে তা তোদের এক বন্ধু হতে অন্য বন্ধুর মনোযোগ রহিত।'

আবান বিন সালিহ ও আবদুল্লাহ বিন আবু নাজিহ <আতাব বিন আবু রাবাহ হইতে ও মুজাহিদ আবু আল-হাজ্জাজ <ইবনে আব্বাস হইতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমাকে বলেছেন যে, যখন আল্লাহর নবী এই যাত্রায় হারাম শরীফের মধ্যে ছিলেন তখন তিনি মায়মুনা বিনতে আল-হারিথ (Maymuna d. al-Harith) কে বিবাহ করেন। আল-আব্বাস ইবনে আবদুল-মুত্তালিব তাঁকে তার সাথে বিবাহ দেন। [5]

আল্লাহর নবী তিন দিন যাবত মক্কায় অবস্থান করেন। তৃতীয় দিনটি-তে হুয়ায়েতিব বিন আবদুল উজ্জা বিন আবু কায়েস বিন আবদু উদ্দু বিন নাসর বিন মালিক বিন হিসল কিছু কুরাইশদের সঙ্গে নিয়ে তাঁর কাছে আসেন, কারণ কুরাইশরা আল্লাহর নবীকে মক্কা থেকে ফেরত পাঠাবার দায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত করেছিল। তারা বলে, "তোমার সময় শেষ, সুতরাং আমদের এখান থেকে চলে যাও।" আল্লাহর নবী জবাব দেন, "তোমাদের কী এমন ক্ষতি হবে যদি তোমরা আমাকে থাকতে দাও, আমি আমার বিয়ের ভোজ তোমাদের দিই, আমরা খাবার তৈরি করি ও তোমরা তাতে যোগ দাও?" তারা জবাবে বলে, "তোমার খাবারের দরকার আমাদের নেই, সুতরাং বিদায় হও।"

তাই আল্লাহর নবী চলে আসেন ও তাঁর মক্কেল আবু রাফি-কে মায়মুনার দায়িত্বভার দিয়ে সেখানে রেখে যান, পরে সে তাকে (আল-তানিমের নিকটবর্তী) সারিফ নামক স্থানে আল্লাহর নবীর কাছে নিয়ে আসে। আল্লাহর নবী সেখানে তার সাথে বিবাহ-বাসর সম্পন্ন করেন, অতঃপর জিলহজ মাসে মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন।'

আল-তাবারীর (৮৩৯-৯২৩ সাল) অতিরিক্ত বর্ণনা: [2] [3]

'আল্লাহর নবী এই আদেশ করেন যে তারা যেন কুরবানির পশুর জন্য উটের পরিবর্তে বিকল্প খুঁজে বের করে - তিনি তাদের সাথে নিজেও এক বিকল্পের সন্ধান পান। তাদের জন্য উটের পরিমাণ ছিল স্বল্প, তিনি গবাদি পশু (কুরবানির) অনুমোদন দেন। আল্লাহর নবী মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন জিলহজ মাসে ও তিনি জিলহজ মাসের পরবর্তী দিনগুলো  (ঐ বছর তীর্থযাত্রীদের ভারপ্রাপ্তে ছিলেন মুশরিকরা), মহরম, সফর, রাবির দুই মাস সেখানেই অবস্থান করেন [মোটামুটিভাবে ৬ই এপ্রিল থেকে ৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত]। জমাদিউল আওয়াল মাসে তিনি সিরিয়ার উদ্দেশ্যে হামলাকারী দল পাঠান, যা মুতা নামক স্থানে এসে চরম বিষাদের কারণ হয়।' ----

আল-ওয়াকিদি <উবায়েদুল্লাহ বিন আবদ আল-রহমান বিন মাওহাব (585) <মুহাম্মদ বিন ইবরাহিম হইতে বর্ণিত, যিনি বলেছেন: 'আল্লাহর নবী সন্ধি-চুক্তির ওমরাহ  (ওমরাহ আল-কাদিয়া)  যাত্রা কালে ৬০-টি মোটাসোটা উট সঙ্গে নিয়ে যান।'

(আল-ওয়াকিদি) <মুয়াধ বিন মুহাম্মদ আল-আনসারী <আসিম বিন ওমর বিন কাতাদা হইতে বর্ণিত, যিনি বলেছেন: 'তিনি অস্ত্রশস্ত্র, শিরস্ত্রাণ (হেলমেট), বর্শা ও এক শত ঘোড়া সঙ্গে নিয়ে যান। তিনি বশির বিন সা'দ (Bashir b. Sa'd) কে অস্ত্রশস্ত্র গুলোর দায়িত্বে (ইন-চার্জ) নিযুক্ত করেন ও মুহাম্মদ বিন মাসলামা-কে নিযুক্ত করেন ঘোড়াগুলোর দায়িত্বে। যখন কুরাইশরা এই খবরটি জানতে পায়, তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে। তারা মিকরায বিন হাফস বিন আল-আখিয়াফ [পর্ব-১১৫] তাদের কাছে পাঠায়, যে ‘মার আল-যাহরান’ (আল-ওয়াকিদি: 'বাতেন ইয়াজাজ [Baṭn Ya’jaj']) নামক স্থানে এসে তাঁর সাথে সাক্ষাত করে। [6] (আল্লাহর নবী) তাকে বলেন, "যুবক বা বয়সকাল, আমার পরিচিতি কখনোই এমন নয় যে আমি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করি। আমি অস্ত্রশস্ত্রগুলো তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবহারের জন্য আনতে চাই না, কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রগুলো আমার কাছাকাছি থাকবে (I do not want to bring in weapons against them, but the weapons will be close to me)।" মিকরায কুরাইশদের কাছে প্রত্যাবর্তন করে ও তাদের-কে তা জানায়। [7] [8]

আল ওয়াকিদি হইতে বর্ণিত: এই বছর জিলহজ মাসে ইবনে আবি আল-আওজা আল-সুলামির (Ibn Abi al-Awja al Sulami) অধীনে বানু সুলায়েম গোত্রের ওপর হামলা-টি সম্পন্ন হয়। আল্লাহর নবী মক্কা থেকে মদিনায় প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর ৫০জন অনুসারীকে সঙ্গে দিয়ে তাকে তাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন, সে তাদের হামলা করার জন্য রওনা হয়।

আবু জাফর (আল-তাবারী) হইতে বর্ণিত: আমি ইবনে হুমায়েদ <সালামাহ <ইবনে ইশাক <আবদুল্লাহ বিন আবি বকর হইতে যা শুনেছি তা হলো: 'বানু সুলায়েম গোত্রের লোকেরা তার মুখোমুখি হয়, আর তাকে সহ তার সকল অনুসারীকে তারা হত্যা করে। যদিও, আল-ওয়াকিদি হইতে বর্ণিত: সে মদিনায় পালিয়ে আসে, কিন্তু তার অনুসারীদের হত্যা করা হয়।' [9]

আল-ওয়াকিদির (৭৪৮-৮২২ খৃষ্টাব্দ) অতিরিক্ত বর্ণনার কিছু অংশ: [3]

'----মুহাম্মদ বিন মাসলামা ঘোড়াগুলো নিয়ে মার আল-যাহরান (Marr al-Zahran) গমন করে। সেখানে, সে একদল কুরাইশদের সাক্ষাত পায় যারা তাকে জিজ্ঞাসা করে ও সে তার জবাব দেয়, "এই হলো আল্লাহর নবী, যিনি এই স্থানে আগামীকাল সকালে আগমন করবেন, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করে।" তারা বশির বিন সা'দের কাছে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দেখতে পায় ও তারা দ্রুতগতিতে রওনা হয়ে কুরাইশদের কাছে এসে তাদের দেখা ঘোড়াগুলো ও অস্ত্রশস্ত্রের খবর জানায়।  কুরাইশরা ভীত হয়ে পরে, বলে, "আল্লাহর কসম, আমরা কোন অন্যায় করি নাই ও আমরা আমাদের চুক্তি ও তার শর্তাবলীর ওপর অটুট আছি। মুহাম্মদ ও তার অনুসারীরা কেন আমাদের আক্রমণ  করবে?"

---- আল্লাহর নবী মার আল-যাহরানে অবতরণ করেন। আল্লাহর নবী অস্ত্রশস্ত্রগুলো বাতেন ইয়াজাজ নামক স্থানে প্রেরণ করেন, যেখানে মন্দিরে তিনি অনেক মূর্তি দেখতে পেয়েছিলেন। কুরাইশরা মিকরায বিন হাফস বিন আল-আহনাফ কে একদল কুরাইশদের সঙ্গে দিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করার জন্য বাতেন ইয়াজাজে পাঠায়। ------' [8]

[অতঃপর, ওমরা পালন শেষে মদিনায় প্রত্যাবর্তন কালে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা কীভাবে হুদাইবিয়া সন্ধি-চুক্তির শর্ত আবারও ভঙ্গ করেছিলেন তার প্রাণবন্ত বর্ণনা আল-ওয়াকিদি (ও ইমাম বুখারী) তাঁর গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, যার বিস্তারিত আলোচনা ইতিমধ্যেই করা হয়েছে ('হুদাইবিয়া সন্ধি: চুক্তি ভঙ্গ দুই (পর্ব-১২৬)'!]

- অনুবাদ, টাইটেল, ও [**] যোগ - লেখক।

>>> আদি উৎসের বিশিষ্ট মুসলিম ঐতিহাসিকদের ওপরে বর্ণিত বর্ণনায় যে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট তা হলো, হুদাইবিয়া সন্ধি-চুক্তির পর কমপক্ষে তিনবার এই চুক্তির প্রায় প্রতিটি শর্ত ভঙ্গ করার পরেও কুরাইশরা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে কোনরূপ প্রতিহিংসার আশ্রয় গ্রহণ করেন নাই। মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের প্রতি তাঁরা যে তখনও কী পরিমাণ সহনশীল ছিলেন তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় আদি উৎসের ওপরে বর্ণিত বর্ণনায়: "যখন মক্কাবাসীরা তাদের আগমনের খবর-টি শুনতে পায়, তখন তারা তাঁর পথ থেকে চলে যায় ও তাঁরা নিজেদের মধ্যে এই বলে বলাবলি করে যে 'মুহাম্মদ ও তার সঙ্গীরা দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিত।'”

মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা 'অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে' তাঁদের নিকটবর্তী এলাকায় এসেছেন, এই খবর-টি জানার পরেও তাঁরা তাদের কোনরূপ বাধা প্রদান করেন নাই। আল-ওয়াকিদির বিস্তারিত বর্ণনায় আমরা জানতে পারি, কুরাইশরা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের সম্মুখীন হতে চান নাই ও তাঁরা মক্কা থেকে সরে গিয়ে নিকটবর্তী পাহাড়ে অবস্থান করছিলেন। শুধু তাইই নয়, ওমারহ পালন শেষে মুহাম্মদ তাঁর মদিনায় প্রত্যাবর্তন কালে আবারও হুদাইবিয়া সন্ধি-চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করা সত্বেও কুরাইশরা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে কোনরূপ সহিংসতার আশ্রয় নেন নাই। তাঁদের এই সহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল!

সত্য হলো, অবিশ্বাসী কুরাইশরা মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের সাথে সর্বদায় সংঘর্ষ এড়াতে চেয়েছিলেন। তাঁরা একজোট হয়ে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে যে মাত্র দু'টি সংঘর্ষে জড়িয়েছিলেন, ওহুদ (পর্ব: ৫৪-৭১) খন্দক যুদ্ধ (পর্ব: ৭৭-৮৬), তার আদি কারণ হলো তাঁদের বিরুদ্ধে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের আগ্রাসী নৃশংস কর্ম কাণ্ড।  সর্বাবস্থায় মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরাই ছিলেন আগ্রাসী!

(চলবে)

তথ্যসূত্র ও পাদটীকা:

[1] “সিরাত রসুল আল্লাহ”- লেখক: মুহাম্মদ ইবনে ইশাক (৭০৪-৭৬৮ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদনা: ইবনে হিশাম (মৃত্যু ৮৩৩ খৃষ্টাব্দ), ইংরেজি অনুবাদ: A. GUILLAUME, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচী, ১৯৫৫, ISBN 0-19-636033-1, পৃষ্ঠা ৫৩০-৫৩১; বিনামূল্যে ডাউনলোড লিঙ্ক:

[2] অনুরূপ বর্ণনা: “তারিক আল রসুল ওয়াল মুলুক”- লেখক: আল-তাবারী, ভলুউম ৮; ইংরেজী অনুবাদ: Michael Fishbein, University of California, Los Angeles, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৭, ISBN 0-7914-3150—9 (pbk), পৃষ্ঠা (Leiden) ১৫৯৩-১৫৯৭; বিনামূল্যে ডাউনলোড লিঙ্ক:

[3] অনুরূপ বর্ণনা (বিস্তারিত): “কিতাব আল-মাগাজি”- লেখক:  আল-ওয়াকিদি (৭৪৮-৮২২ খৃষ্টাব্দ), ed. Marsden Jones, লন্ডন ১৯৬৬; ভলুম ২, পৃষ্ঠা ৭৩১-৭৪০; ইংরেজি অনুবাদ: Rizwi Faizer, Amal Ismail and Abdul Kader Tayob; ISBN: 978-0-415-86485-5 (pbk); পৃষ্ঠা ৩৬০-৩৬৫

[4] Ibid মুহাম্মদ ইবনে ইশাক: ইবনে হিশাম নোট নম্বর ৭৮০, পৃষ্ঠা ৭৭১
'তিনি উওয়ায়েফ বিন আল-আদবাত আল দিলি (Uwayf b. Al-Adbat al-Dili) কে মদিনার দায়িত্বে রাখেন। এই তীর্থযাত্রাকে 'প্রতিশোধের ওমরাহ যাত্রা’ ও বলা হয় এই কারণে যে হিজরি ৬ সালের যে পবিত্র জিলকদ মাসে তারা তাকে বাধা প্রদান করেছিলেন, আল্লাহর নবী হিজরি ৭ সালে ঐ মাসটিতেই তার প্রতিশোধ নিয়ে মক্কা প্রবেশ করেছিলেন, যে মাসটিতে তারা তাকে বাধা প্রদান করেছিলেন।’

[5] Ibid ইবনে ইশাক: ইবনে হিশাম নোট নম্বর ৭৮২ ও আল-তাবারী নোট নম্বর ৫৭৮:
‘সেই সময় মায়মুনা ছিলেন বিধবা; তিনি ছিলেন মুহাম্মদের চাচা আল-আব্বাসের পত্নী উম্মে আল-ফাদলের ভগিনী। তিনি তার বোন-কে তার বিষয়-টি দেখাশুনার জন্য ন্যস্ত করেন, তার বোন সেই দায়িত্ব তার স্বামী আল-আব্বাসের ওপর দেন। অতঃপর আল-আব্বাস মক্কায় তাকে আল্লাহর নবীর সাথে বিবাহ দেন ও আল্লাহর নবীর পক্ষ থেকে তাকে যৌতুক বাবদ ৪০০ দিরহাম প্রদান করেন।’
[6] মার আল-যাহরান - 'মক্কা থেকে ৫ মাইল দূরবর্তী একটি স্থান।'
[7] Ibid: আল-তাবারী - পৃষ্ঠা ১৫৯৭
[8] Ibid: আল-ওয়াকিদি -পৃষ্ঠা ৭৩৩-৭৩৪, ইংরেজি অনুবাদ - পৃষ্ঠা ৩৬১
[9] অনুরূপ বর্ণনা: Ibid আল-ওয়াকিদি, পৃষ্ঠা-৭৪১, ইংরেজি অনুবাদ: পৃষ্ঠা ৩৬৫


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন